ফোনটায় টিংটাং করে মেসেজ ঢুকছে একের পর এক…, তমাল নয়তো। হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরতে যেতেই…
বউমা…। মাগো মা সোজা ওপরের ঘর থেকে এসে শুয়ে আছ? ভাতটা কে বসাবে শুনি? ওদিকে শ্রেষ্ঠার বমি হতে শুরু করেছে।
কস্তুরী চুপচাপ উঠে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার আগেই ফোনটা আরও কয়েকবার বিপ বিপ শব্দ করে ওঠে। কী মনে হতেই ফোনটা হাতে তুলতেই ওর গোটা শরীরটা হিম হয়ে যায়।
একটা অর্ধউলঙ্গ নারী শরীর। তোয়ালে খুলে উন্মুক্ত পিঠে ছড়িয়ে দিল ঢেউ খেলানো চুল। তারপর বুকের নরম অংশে একটু একটু করে জড়িয়ে নেয় অন্তর্বাস। কস্তুরী। ও নিজে? কিন্তু। এটা তো ওরই ঘর। পায়ে পায়ে জড়িয়ে আসে। কী করে সম্ভব? কে এই ছবিটা তুলেছে? এই তো ওর বিছানা, একই দেয়াল, একই আলমারি তার মানে এই ঘরেই? কে তুলেছে ভিডিও?
মনে পড়ছে সেদিন তো ঠাকুমা ছাড়া আর কেউ এ-বাড়িতে ছিল না। সবাই পাশের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গেছিল। একতলার বাথরুমটা সবার সামনে হওয়ায় বরাবরই শান্তিমতো স্নান করতে পারে না। সেদিন অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে তোয়ালে জড়িয়ে ঘরে এসেছিল। নাহলে এভাবে তোয়ালে জড়িয়ে কোনওদিন কস্তুরী বাথরুম থেকে ঘরে আসে না। গা মুছে শাড়ি পরে ঘরে ঢুকতে হয়।
তোমার একটু হট ছবি পাঠালাম, শৈবালদা…!
শৈবালদার মেসেজ। হাত পায়ে রক্ত চলাচল থেমে যায় মুহূর্তের মধ্যে। শৈবালদা ছবিটা তুলেছে? এটা যদি বাড়ির সবার সামনে। না না এমনটা হবে না, হতে দেওয়া যায় না।
তমালকে বলতে যেও না তাতে আরও বিপদে পড়বে। কাল দুপুরে দেখা করো। না হলে জামাইবাবুর সঙ্গে যা লটরপটর করেছিলে সব ফাঁস করে দেব। আর সারা দুনিয়া দেখবে তোমার মাখন শরীরটা। তখন পালিয়ে বাঁচবে না। বুকের ওপর আচমকা কেউ যেন ভারী কিছু চাপিয়ে দিচ্ছিল। নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না কস্তুরী।
তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছ? বললাম না তাড়াতাড়ি ভাতটা বসাও। কী বেয়াড়া মেয়েকে বাবা। কখন থেকে বলছি কথা নেয় না কানে। শাশুড়ি রান্নাঘরের বাসনকোসন নাড়াচাড়া করতে করতে অসম্ভব জোরে জোরে বলছিল।
পেট মুচড়ে বমি উঠে আসছিল কস্তুরীর। ঘামে ভেজা শরীরটা হঠাৎ করেই হালকা বোধ হচ্ছিল। কোনওমতে দেয়ালে ঠেস দিলেও একটু একটু করে বিষণ্ণ ধুলোটে ভাব জড়ো হচ্ছিল চোখের সামনে। ধোঁয়া ধোঁয়া অংশটা গ্রাস করছিল ওর চোখ, নাক এমনকী মাথাও। কস্তুরী বুঝতে পারছিল একটু একটু করে তমালের মায়ের গলাটাও কেমন ভেঙেচুরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। দুহাতে কান চেপে ধরে ও। দেয়াল ধরে বসে পড়ে।
শীত শীত ঠান্ডা রেশ ছেঁকে ধরে চারপাশ থেকে। খুব শীত। কনকনে হাওয়ায় যুঝতে যুঝতে ও এসে পৌঁছোয় নিবিড় কালোর মাঝে। ওই তো উঁচু একটা ঢিবি। ওখানেই যেতে হবে ওকে। কস্তুরী জোরে জোরে পা ফেলতে চায় কিন্তু কিছুতেই পারে না। কেউ যেন প্রাণপণে ওর পাটাকে কোনও এক অদৃশ্যের দিকে টেনে ধরেছে। চিত্কার করে ওঠে কস্তুরী। কিন্তু একটা কারুর কাছে ওর গলার আওয়াজ পৌঁছোয় না। নাক জুড়ে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ এসে বসে।
গন্ধটা কি হাওয়ায় ভেসে আসছে? দূর থেকে। এত নেশা কেন গন্ধটায়? কস্তুরীর শরীরটা মনে হচ্ছে নিজে থেকেই দুলে দুলে উঠছে। কেমন ঝিমঝিম চারদিক। ঝাঁঝালো গন্ধে গলা চোখ বুক জ্বলছে। তাও কস্তুরী পালাতে পারছে না। কেউ যেন ওকে পেরেক দিয়ে মাটির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। বেশ বুঝতে পারছে বুকের ধুকপুকানির গতিও শ্লথ হয়ে আসছে।
কানের কাছে কেউ যেন চুপিসাড়ে বলে যাচ্ছে, নেই নেই এর থেকে তোমার মুক্তি নেই। কোনও ভাবেই মুক্তি নেই। এগোও কস্তুরী। এগিয়ে যাও…। তোমাকে একাই এগোতে হবে। কেউ তোমার হাত ধরবে না।
ঝাঁঝালো গন্ধে উন্মাদের মতো শরীর আর মন নিয়ে কস্তুরী উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায়। ঢিবিটার আরও কাছাকাছি পৌঁছোয় ও। আর তারপরেই বাতাসের সমস্ত শনশনানি এফোঁড় ওফোঁড় করে একটা তীব্র আঘাত হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওর শরীরটায়। ঠিক ওর পিঠে। খানিকটা কাঁপুনি। আরও জ্বালা। আঘাতের জায়গাটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।