ঝড়ের মতো এসে পড়ল আর একটা প্রেম!

এখন একে কোথায় বসাই

একটা ঘরে ঘর পরিজন, অন্যটাতে

লেখার কাগজ বইপত্তর

বারান্দাভর

অতিথিস্বজন!

কোথায় বসাই?

—জয় গোস্বামী

একবারের পরিবর্তে সনকা আজ চায়ে দু-দুবার চিনি দিয়ে ফেললেন। মেয়ে বলল, আজ নাকি ভ্যালেনটাইন্স ডে, অর্থাৎ প্রেম দিবস। আর তারপরেই সে করে বসল সেই অব্যর্থ, অস্বস্তিকর, অমোঘ প্রশ্নটা মা তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড ছিল না?

উত্তর দিতে গিয়ে কেমন হোঁচট খেলেন সনকা। সময় সত্যিই তো এমন সাবলীল ছিল না প্রেমের কথা বলা। প্রেম যেন এক রুহ-খাস আতরের মতো অনুভতি যা সঙ্গোপনে রুমালের খুঁটে বেঁধে রাখতে হতো, অথচ তার সুগন্ধ ঘিরে থাকত দিনভর। যে-মানুষটাকে সনকা বিয়ে করেছেন, তাঁর সঙ্গে এই এতবছরের গাঁটছড়ায় সত্যই কি বুঝেছেন, কোনটা মায়া আর কতটাই বা প্রেম? কোন উঠোনটুকু পেরোলে তবে এক গভীর-গোপন পুকুরঘাট মেলে, নীরব অবগাহনের জন্য!

প্রথম প্রেম। শব্দবন্ধটা শুনলেই একটা চমৎকার ঘুমভাঙা সকাল, একটা পাটভাঙা আঁচলের খসখসানি, রজনীগন্ধার মিঠে মৌতাত মনে পড়ে। সনকাদের সময়ে প্রেমপর্বটা শুরু হতো বিয়ের পর। তবে এদিক-সেদিক নিয়ম ভেঙে প্রেম কি হতো না? নিদেনপক্ষে একটা হাতে লেখা চিঠির সারপ্রাইজ ভিজিট! হতো অবশ্যই। কিন্তু সেসব প্রেমের পরিণতি অধিকাংশ সময়ে পরিণয় অবধি পৌঁছোত না। বাড়ির রক্ষণশীল মনোভাব ভেঙে কার সাধ্যি ছিল ‘লভ-ম্যারেজ করব’, একথা বলার!

ফলে অবশেষে যা হওয়ার, তাই হতো। বাড়ির মনোনীত পাত্রের সঙ্গে, অচেনা আনন্দ আর দুশ্চিন্তার স্রোতে ভাসতে ভাসতে একটা নতুন জীবনে প্রবেশ করা। সনকাদের প্রজন্মে প্রথম প্রেমগুলো একটা কল্পনাবিলাসই হয়ে থেকে যেত। যেখানে কল্পনায় উড়াল দিলেই হৃদয়ের গভীরে টলটলিয়ে উঠত একখানা দীঘি- আর দীঘিভরা এক অপার্থিব মুখ, যার দিকে তাকিয়ে থাকাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে হতো। এবং থাকত দুটো আশ্চর্য হাতের স্পর্শ, যার ঘেরাটোপে পৃথিবীর সেরা নিশ্চয়তা লুকানো। কিংবা একটা বিশেষ গন্ধ, যা কিনা নিমেষে চিনিয়ে দিত সেই প্রাণের মানুষটিকে। এভাবেই কোনও অলীক কণ্ঠস্বরে, বিশেষ ডাকনামে গেরস্থালি সাজাত দুটি মানুষ। কল্পনায় আর বাস্তবে, প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসেবনিকেশ করা হতো না এই-ই ছিল তখনকার প্রেম।

সে যুগে চিঠিই ছিল প্রেমকাব্যের মূল নায়ক। চিঠিতেই জানানো হতো ভালোবাসার নিবেদন। নির্জন দুপুরে ডাকপিয়নের প্রতীক্ষা থাকত, বারবার লেটার বক্স খুলে দেখার একটা আনন্দ থাকত। একই চিঠি বারবার, বহুবার পড়ার মধ্যেও একটা সুখ মিশে থাকত। কোনও গোপন টিনের বা কাঠের বাক্সে জমা হতো সেই সব চিঠি। মুখ ফুটে সরাসরি প্রেমের আবেদন জানানো সাহসে না কুলোলে চিঠির মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করা, তারপর অপেক্ষার প্রহর গোনা প্রত্যুত্তরের আশায় এই ছিল রীতি।

লেখক বুদ্ধদেব গুহ-র বই বুকে চেপে যাদের একফালি বযঃসন্ধি কেটে গেছে, তারা জানেন, এই সব চিঠির ভাষা-মাধুর্য। বাংলায় পত্র সাহিত্যের এক দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন এই লেখক। শুধুমাত্র ভাষার ব্যঞ্জনায় বলা হয়ে যেত কত না বলা কথা। লেখার এবং পড়ার অভ্যাস সেসময় যেন একটি প্রজন্মের মূল হাতিয়ার ছিল, যার বুনিয়াদে চলত মন চেনাচিনির খেলা। আসলে প্রেম তো শুধু সামনে বসে কথা বলাতেই ফুরিয়ে যায় না। বরং দূরে থেকেও অনেক না-বলা কথার মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় সেই ভালোলাগার ফল্গুধারা।

প্রেমের চিঠি আদান-প্রদানে সাধারণত সাহায্য করত বন্ধু বা বান্ধবীরা। প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে সেই পত্র জায়গামতো পৌঁছোনো ছিল একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। তখন সকলেই প্রায় সকলের আত্মীয়স্বরূপ ছিলেন, প্রতিবেশীরা ছিলেন আপনজনের মতো। ফলে একই পাড়ায় থেকে প্রেম করার জো ছিল না। তাহলেই ঢিঢি পড়ে যেত। এত বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে সেই সব চিঠিপত্র সংরক্ষণ করার নিতান্ত কোনও উপায় না থাকলে, অগত্যা চিঠি ছিঁড়ে বা পুড়িয়ে ফেলতে হতো।

অনেকেই নিজে চিঠি লেখার বা লেখানোর পরও বারবার পাঠ করে শুনতেন বা শোনাতেন যাতে কোনও তথ্য অসম্পূর্ণ না থাকে। বাহকের কাছ থেকে যে-কোনও ভাবে জায়গামতো না গিয়ে অভিভাবক বা মুরব্বি কারও হাতে চিঠি গেলে, দুর্গতির শেষ থাকত না। তবে এর চেয়ে দুর্গতি হতো প্রেমে প্রত্যাখ্যান জুটলে। আবেগ আর কান্নার সেই সব সংগোপন মুহুর্ত, আমৃত্যু যন্ত্রণা হয়ে বুকের এক গোপন কুঠুরিতে যেন চেপে বসে থাকত।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...