আসলে সেযুগে প্রেম ছিল উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার মতো, রবি ঠাকুরের কবিতার মতো। সরস্বতী পুজোর অঞ্জলির ফুলের মতো মুঠোয় পড়ে থাকত সেই প্রেম, যার কথা কেউ কোনওদিন জানতেও পারত না। প্রেম নিয়ে লেখেননি এমন কবি মেলা ভার, প্রেমের ছবি আঁকেননি এমন চিত্রকরও দুর্লভ। শিল্পীদের একটা সুবিধা আছে, তারা যেটুকু আড়াল করার, সেটুকু লুকিয়ে রেখে বাকিটা প্রকাশ করে ফেলতে পারেন। এতে শ্যামও থাকে, কুলও যায় না। কিন্তু বাকিদের কষ্ট বোধহয় আরও বেশি। কেউ কেউ প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিয়ে করতেন না। আজীবন সেই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতেন। কী মহিমা প্রেমের!
আসলে প্রেমের সবটুকু স্ফূরণ বোধহয় ট্র্যাজেডিতেই সম্পূর্ণ হয়। মানুষ তো আজীবন বিচ্ছেদ আর অপ্রাপ্তিকেই সেলিব্রেট করেছে। কী শিল্পে, কী জীবনে। যা জীবনে সফল, স্মৃতিতে বা শিল্পে তার দাম মেলেনি। তাই রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট আজও প্রেমের শ্রেষ্ঠ উপাখ্যান হয়ে থেকে গেছে। পথ যেখানে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই তো রাস্তা শুরু। তা সে নহন্যতে-র মির্চা আর রু-এর কাহিনিই হোক, কিংবা শেষের কবিতার অমিত-লাবণ্য। এমন বহু যুগলেরই বাস্তবে একসঙ্গে থাকা হয় না, নানা কারণে। কিন্তু ভালোবাসাটা থেকে যায় অমলিন। আর এই বিচ্ছেদই নানা সময়ে কবিদের দিয়ে লিখিয়েছে প্রেমের কবিতা বা উপন্যাস।
কে না জানে কাদম্বরী দেবীর প্রতি রবিঠাকুরের অন্ধ মুগ্ধতা আর নির্ভরতার কথা। বৌঠানের অকালপ্রয়াণের পর রবির হাজারো লেখায় তার ছায়া ফিরে ফিরে আসার কথা। তার পরও রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসেছেন, আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অত গভীর রেখাপাত আর কোনও সম্পর্ক ফেলতে পেরেছে কি? সম্ভবত পারেনি। তিনিও সারাজীবন বিচ্ছেদের উৎসবে মেতেছেন।
সময় দ্রুত পালটে যাচ্ছে। বিপণনী দুনিয়া বলে, প্রেম ভেঙেছে তো কী হয়েছে, মুভ অন। সময়টাকে কবজিতে বেঁধে রাখো। মতের অমিল হলেই চিরতরে আড়ি, তোমাকেও ছেড়ে যেতে পারি। বিষাদের উদযাপনের জায়গাটা হয়তো বেপরোয়া ভাবে হাইওয়েতে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আর পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ বা ইচ্ছে নেই এই প্রজন্মের। যা গেছে তা যাক, অন্য কোথাও অন্য কোনও খানে আবার বাঁধা পড়বে মন। এটাই তো মনের চরিত্র। এটাই জেট যুগের গতিবিধি।
চিঠি নয়, এটা চ্যাটিং-এর যুগ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বল্পখরচে চ্যাটিং করেই গড়ে উঠছে সম্পর্ক। এক সম্পর্কের ভিত পোক্ত হতে না হতেই সুনামির মতো এসে পড়ছে অতিরিক্ত চাহিদা বা প্রত্যাশার ঝড়। ফল অবধারিত, বিপর্যয়। এর কারণ বোধহয় পরস্পরের মধ্যে কোনও আড়াল বা নান্দনিক রহস্য না থাকা। এখন উভয়ে আলাপচারিতা দূরভাষেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং ভেসে বেড়ায় ওয়ে ক্যামেরার মাধ্যমে, মনিটরের পর্দায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে আমরা ইন্টারনেট, ই-মেইল, ভয়ে মেইল, চ্যাটিং, ফোন ও মোবাইল-এর নানা অ্যাপ পেয়েছি কিন্তু হারিয়েছি আরও বেশি। হারিয়েছি রোদ মরে আসা বিকেলে ঘন হয়ে হেঁটে যাওয়ার আনন্দ, দুদণ্ড পরস্পরকে ছেড়ে থাকার বেদনা, হঠাৎ চিঠিতে প্রেম নিবেদনের ভালোলাগা। এখন প্রেম-ভালোবাসা, রিলেশন আসলে ফোর জি কানেকশনের মতো সুলভ হয়ে গিয়েছে। এই চাইলাম, ভালোবাসলাম, আবার হুটহাট ব্রেকআপ করে ফেললাম।
অপ্রেম বা ভাঙা-প্রেমের আঙিনায় যুক্ত হয়েছে এক নতুন কনসেপ্ট, ব্রেক-আপ পার্টি। অর্থাৎ কিনা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের সামাজিক অনুমোদন। সেলিব্রিটিরাও বাদ পড়ছেন না এই বিচ্ছেদের উদ্যাপন থেকে। সেই ছবি ফেসবুকে আপলোড করে অনায়াসে বিজয়ে হাসি হাসছেন সদ্য বিচ্ছিন্ন যুগল। আবার একই সময়ে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে নিজের ভালোবাসার মানুষকে কমপ্লিমেন্ট দিয়ে হরবকত প্রেমের ঘোষণা করছেন সেলিব্রিটিরা। প্রয়োজনে প্রেমও ভাঙছেন সগর্বে। সবই ভীষণ পাবলিক, সবই বড়ো প্রকট। বাইরের লোকের তোয়াক্কা না করে পাবলিক ডিসপ্লে অব অ্যাফেকশন কিংবা ডিসস্যাটিসফ্যাকশন।
আর প্রেমে সফল হয়েছেন বলে মনে করছেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রেও সঙ্গীর সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে না দিলে যেন, সম্পর্কের বিজ্ঞাপনটাই সম্পূর্ণ হয় না। সঙ্গে প্রেমে গদগদ ক্যাপশন প্রিয়তম বা প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে। তবেই বুঝি ষোলো কলা পূর্ণ হয়। শেক্সপিয়রের নাটকে নায়ক অর্ল্যান্ডো গাছের গুঁড়িতে লিখেছিলেন প্রেমিকা রোসালিন্ডের নাম। আধুনিক সময়ে সেই গাছ হয়ে উঠেছে সেশ্যাল মিডিয়ার দেয়াল। সেখানেই নতুন প্রজন্ম দেখনদারির নেশায় মেতেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আটকে গিয়েছে জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, মুহূর্ত, অনুভূতি।
কিন্তু এত আয়োজন সত্ত্বেও প্রেমটাই যে মিসিং। আর সেই জন্যই এখন প্রেম হয় যত তাড়াতাড়ি, রিলেশনশিপ স্টেটাস বদল হয় তার চেয়ে দুরন্ত গতিতে। প্রেমটাকে আগলানোর বদলে, আগল খোলাতেই যেন বেশি আনন্দ। বদলে গেছে প্রেমের উপপাদ্য। কোনও সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয়, এমনই একটা ধারণাকে সঙ্গে নিয়ে যেন তৈরি হয় এখন সম্পর্কগুলো। এক দিকে প্র্যাকটিকাল বলতেই হবে এই প্রজন্মকে। তাই বিরহ তাদের স্পর্শ করে না, বিচ্ছেদ তাদের কাঁদায় না। গভীর রাতের অগভীর সিনেমায় প্রেম চায় নাটুকে বিদায়…।
আসলে আমরা এখন একটা নিজস্ব স্পেসে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই স্পেস জুড়ে শুধুই আয়না। কেবল নিজেরই প্রতিবিম্ব। তাই আমরা আর কোনও মুখ খুঁজি না। অন্য কোনও সম্পর্কের মুখাপেক্ষী নয় এই প্রজন্ম। নিরন্তর এক্স ইকুয়ালস টু প্রেম ধরে নিয়ে অঙ্ক কষে চলেছে তারা। ফলাফল? থাক, এই উত্তর আজ নয়। অন্য কোনওদিন না হয় দেব। এখন সেলিব্রেশন-এর সময়, উৎসবটা যে ভ্যলেনটাইন্স ডে!