স্যারের সঙ্গে আলোচনা করার পরে সেদিনকার মতো শিঞ্জিনি ইন্সটিটিউট থেকে বেরিয়ে এসোপ্ল্যানেড থেকে ভলভো বাস ধরে আসানসোলে ফিরে গিয়েছিল। তারপর দিন পনেরো আর কোনও সাড়াশব্দ নেই শিঞ্জিনির। সোহম সেন প্রায় রোজই ভাবেন, কী হল মেয়ের কে-জানে। হঠাৎ সেদিন ইন্সটিটিউটে পৌঁছে নিজের চেম্বারে ঢুকতেই, টেবিলের উপরে রাখা ল্যান্ডলাইন ফোনটা ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল। ফোনের রিসিভার তুলতেই, ওপার থেকে শিঞ্জিনির গলা ভেসে এল,

—স্যার, শিঞ্জিনি কথা বলছি, জয়পুর থেকে। আজ তিনদিন হল আমি জয়পুর এসেছি। আপনার কথাই একদম ঠিক স্যার! আপনি যে বলেছিলেন, ছেলেটার ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়, সেটাই সত্যি। বয়স অনুসারে পিছিয়ে থাকা একটা মানুষ। গত বছর-বারো ধরে স্পেশাল এডুকেটরের কাছে বেশ কিছু জিনিস শিখে খানিকটা ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। ছেলেটার বাবার প্রস্তাব, ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের ব্যবসাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে।  ওনারা আমাকে বনসল ফার্মাসিউটিকাল এবং সফ্টওয্যার কোম্পানির পার্টনার করে নিতে চাইছেন। প্রতি মাসে ওরা আমাকে দশ লক্ষ টাকা করে দেবেন।

শিঞ্জিনিকে মাঝপথে থামিয়ে সোহম সেন বললেন, কিন্তু এর পরিবর্তে ওরা তোমার পায়ে দশ লক্ষ শিকল পরাবে, সেটা মাথায় রেখো। তুমি তোমার পেশায় অনেক উপরে উঠতে চাও, সেটা ভালো কথা। কিন্তু তোমাকে ওরা ফিউডাল সংস্কৃতির কোন বাঁধনে বাঁধতে চাইছে, তা তোমাকে বুঝতে হবে।

সোহম সেনের কথায় শিঞ্জিনি মনে জোর পায়। ও সঙ্গে সঙ্গে জোর গলায় বলে ওঠে, ওরা আমাকে কোনও বাঁধনে বাঁধতে পারবে না। আমি আমার বাবা-কাকা সকলকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছি, আমি তোমাদের হবু জামাইয়ে নার্স হতে যেমন পারব না, তেমনই ওই ছেলের ঔরসে সন্তান ধারণ করলে, সেই সন্তানও মানসিক ভাবে দুর্বল হতে বাধ্য। কিন্তু আমার কথা শোনার পরে বাবা ভয় পাচ্ছেন, ডাউরি হিসাবে দেওয়া বাবার তিরিশ লক্ষ টাকার পুরোটাই বুঝি জলে চলে গেল।

কাকারা বাবাকে বুঝিয়েছেন, ওদের ব্যাবসার পার্টনার হতে পারলে, ওই টাকাটা ফিরে আসতে ছয় মাস সময়ও লাগবে না। তাছাড়া ওই পরিবারে বিয়ে হলে, আমার সারাটা জীবন ফিনান্সিয়ালি সিকিওর্ড থাকবে। বেশ জোরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে চুপ করে যায় শিঞ্জিনি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে আবার কথা বলে সে, আমার কোনও ড্রাস্টিক ডিসিশন বাবা যে সহ্য করতে পারবেন না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমি চাই না আমার কারণে বাবার কোনও ক্ষতি হয়ে যাক। এ এক নতুন সংঘাত! আমি বুঝে উঠতে পারছি না, এই সংঘাতের থেকে আমি মুক্তি পাব কীভাবে!

—তুমি কর্পোরেট কালচারের অভিজ্ঞতা অলরেডি অর্জন করেছ। সেখানে শোষণ আছে কিন্তু তার পাশাপাশি ফ্রিডম অফ সেক্স আছে, তোমার ব্যক্তিগত জীবনের সবরকমের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ফিউডাল সোসাইটির ম্যারেজ কালচারে তোমাকে স্লেভ হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন। তুমি তোমার হবু স্বামীর ব্যাবসায় যোগ দিলে, তোমার জয়েন্ট প্রপার্টি থাকবে, জয়েন্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে। কিন্তু কোথাও নিজের কোনও ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোল থাকবে না কখনও। তুমি জয়পুরের ব্যাংকে স্যালারি অ্যাকাউন্ট ওপেন করে, স্যালারিড মেম্বার হয়ে থেকে যেতে পারো, তাদের ব্যাবসায়। দ্যাখো শিঞ্জিনি, আমি জানি তোমার হাতের লেখায় মাল্টি-স্ল্যান্টের ছড়াছড়ি। অত সহজে তোমার মনের সংশয় দূর হওয়ার নয়। এত দূর থেকে এইভাবে তোমার মনের সংশয় দূর করা সম্ভবও নয়। ফিউডাল সংস্কৃতি আর কর্পোরেট সংস্কৃতি এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে বিদ্যমান যে-সংঘাতের মধ্যে তুমি পড়েছ, তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা তোমাকেই করতে হবে। আমি শুধু তোমার সামনে বড়োজোর এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার একটা রূপরেখা এঁকে দিতে পারি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে শিঞ্জিনি!

–ঃসমাপ্তঃ–

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...