মা বাবার সঙ্গে বাচ্চার Relationship কেমন হওয়া উচিত বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মা বাবা নিজেদের মধ্যে কীধরনের আচরণ করছেন সেটা শিশুর বেড়ে ওঠার ওপর খুব গভীর প্রভাব ফেলে। এতে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য কেমন হবে, পড়াশোনায় সে কেমন করবে, এমনকি ভবিষ্যতে এই শিশু যেসব সম্পর্কে জড়াবে সেগুলো কেমন হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনও সখনও বড়োদের মধ্যে কলহ এতটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে, স্বামী-স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের পথে পা বাড়ায়। একে অপরকে সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শুধু ডিভোর্সই নয়, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী কেউ একজন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে যদি জড়িয়ে পড়েন, তাহলে বাড়িতে থাকা বাচ্চার উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। কিন্তু সমস্যা হল এই পরিস্থিতি হলে বাচ্চাটি কোথায় যাবে? সে কী করবে আর না করবে বুঝে উঠতে পারে না।
কী কী কারণে বড়োদের আচরণ শিশুমনে প্রভাব ফেলে সেটা আমাদের জানতে হবে। আগেই বড়োদের নিজেদের মধ্যে ডিভোর্সের হুমকি এবং ব্যবহারে পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, বাকি কারণগুলোও এখানে আলোচনা করা হল।
আর্থিক সমস্যার প্রভাব বাচ্চার উপর
কলকাতার বাসিন্দা অলোকের চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে প্রায়শই বাড়িতে টাকা-পয়সা নিয়ে স্ত্রীয়ের সঙ্গে ঝগড়া চলতেই থাকত। ভালো আবাসনে ফ্ল্যাট ছিল, ছেলেমেয়েরাও ভালো কলেজে পড়ত। চাকরি যেতেই নিজের বাড়ি, ভাড়ায় দিয়ে, অল্প টাকায় বাড়ি ভাড়া করে পরিবার নিয়ে এসে উঠেছে টাকা সাশ্রয়ের জন্য। কম ফি যেখানে সেই স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করে দিয়েছে। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোথাও থাকতে হলে সংসারে লড়াই ঝগড়া তো হবেই।
বাড়িতে সারাদিন বসে থেকে অলোক স্ত্রীয়ের গতিবিধির উপর নজর রাখা আরম্ভ করল। স্ত্রী কী করছে, ওটা কেন করছে না ইত্যাদি বলতে আরম্ভ করল স্ত্রীকে। স্ত্রীয়েরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। একে তো অর্থের সমস্যা তার উপর স্বামীর এই নজরদারি। ঝগড়া এতটাই বেড়ে গেল রাগের মাথায় দু’জনেই সন্তানদের গায়ে হাত তুলতে আরম্ভ করল।
দুটি সন্তানই কৈশোর ছাড়িয়ে সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করেছে। মা-বাবার কাছ থেকে টাকার খোঁটা শুনতে শুনতে বড়ো হচ্ছিল। কিন্তু ভাইবোন দু’জনে মিলে ঠিক করল নিজেদের খরচ ওরা নিজেরা চালাবে এবং বড়োদের ঝগড়ার প্রভাব নিজেদের জীবনে পড়তে দেবে না। অলোকের মেয়ে আশেপাশে বেশ কয়েকটা টিউশন জোগাড় করে নিজের হাতখরচের ব্যবস্থা করে নিল আর ছেলে একটা স্টোরে পার্ট টাইমের চাকরি জোগাড় করে নিল। এতে দুটো লাভ হল— মা-বাবার রোজের খিটমিট বন্ধ হল আর সন্তানরা আত্মনির্ভরও হতে শিখল।
বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক
অজয়কে প্রায়ই ব্যাবসার কাজে শহরের বাইরে যেতে হয়। দুটি সন্তান, মেয়ে দশম শ্রেণিতে আর ছেলে দ্বাদশ ক্লাসে। অজয়ের স্ত্রী চাকরি করে না। বাড়িতে থাকে বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ক্লাব পার্টি করে বেড়ায় সময় কাটাবার জন্য। অজয়ের নির্দেশ ওর অনুপস্থিতিতে বাচ্চারা যেন মায়ের কথা শুনে চলে এবং মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যায়।
একদিন ছেলে রাত করে পড়াশোনা শেষ করে নীচে বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করছিল। তখনই মা-কে এক অচেনা পুরুষের গাড়ি থেকে নামতে দেখে। তাও সবই ঠিক ছিল কিন্তু নিজের মা-কে পরপুরুষের বক্ষলগ্না হতে দেখে ও নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না। ছেলে চুপ করে থাকলেও এ ধরনের কথা বেশিদিন চাপা থাকে না।
কয়েকদিনের মধ্যেই পাড়াতে অজয়ের স্ত্রীকে নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এ ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাট করে অজয়ের কানে এসে পৌঁছোল গুঞ্জন। শুরু হল অশান্তি। অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীকে কথা বলতে দেখলেই অজয়ের মনে সন্দেহ বাসা বাঁধতে আরম্ভ করত। সংসারে অশান্তি শুরু হল। বাচ্চাদের কানেও প্রতিবেশীদের চাপা ফিসফিসানি এসে পৌঁছোত। অনেকে ওদের দেখে হাসাহাসিও করত। বাচ্চাদের খারাপ লাগত আবার মা-বাবার উপর রাগও হতো। কিন্তু ছেলের নিজের কেরিয়ার তৈরির চিন্তা ছিল, ও ভালো করেই জানত পড়াশোনা না করলে রেজাল্ট খারাপ হবে।
অজয় এবং ওর স্ত্রী মাঝেমধ্যে সন্তানদের কাছে একে অপরের নামে নিন্দে করত। ছেলে একদিন স্পষ্টই জানিয়ে দিল, ‘তোমাদের ঝগড়া নিজেদের মধ্যেই রাখো, আমাদের নিজেদের জীবন নিজেদের মতো করে চালাতে দাও। ছেলে পড়াশোনা করে সময় পেলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একটু ঘুরে আসত বা সিনেমা দেখতে যেত। ছোটো বোনও দাদার দেখাদেখি ওটাই করত।
নিজের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেওয়া
শো বিজনেস-এ থাকা নিহাল নিজের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে খুব ভালো এবং সৎ ব্যবহার করত ঠিকই কিন্তু নিজের স্ত্রীয়ের সঙ্গে নয়। সবসময় নিজের সন্তানদের বয়সি মেয়েদের দ্বারা ঘিরে থাকতে ভালোবসত নিহাল এবং নিজের স্ত্রীকে অসম্মান করত। অশান্তি এতটাই চরমে পৌঁছেছিল ওদের ডিভোর্স প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করা হলে ওরা জানায় মা-বাবা কারও সঙ্গে ওরা থাকতে চায় না। ওরা একলা কোথাও থাকতেও রাজি কারণ মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া ওরা সহ্য করতে পারে না।
আসলে অজয়ের সন্তানরা ওদের মা-বাবার ঝগড়া দেখতে দেখতেই বড়ো হয়েছে। তাই ওরা মা-বাবাকে কোনওদিন ভালোবাসতে পারেনি, তারাও কি সন্তানদের আদৌ ভালোবাসা দিয়েছিলেন? ঝগড়ার কারণে অনেকদিন বাড়িতে খাবার পর্যন্ত রান্না হতো না। কত উৎসবে হয়েছে, বাড়িতে যখন অতিথি এসেছে খুব এলাহি ভাবে তাদের খাতির করা হয়েছে। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পরেই বাড়ির পরিবেশ আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে। বাচ্চারা এই সত্যটা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিল বলেই মা- বাবার সঙ্গে থাকতে তারা অস্বীকার করে।
এই প্রতিটা ঘটনায় বাচ্চারা মানসিক ভাবে মা-বাবার ঝগড়ার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এটাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বড়োদের ঝগড়ার প্রভাব কিছুতেই নিজেদের জীবনে পড়তে দেবে না। সম্পর্ককে সম্মান করাটা সকলের উচিত আর বাচ্চাদের বড়োদের ঝগড়ায় কখনও টেনে আনা উচিত নয়। বাচ্চাদেরও বড়োদের এই ঝগড়ায় নিজের মন মেজাজ এবং জীবন নষ্ট করা বাঞ্ছনীয় নয়।
এখন বাচ্চারা অনেক বেশি মানসিক ভাবে পরিণত। তারা মানে যে, মা-বাবা যদি পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করে, Relationship মেনটেইন করে পরিবারের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারে তাহলে সেই ভুলের দায়িত্ব তাদের নিজেদেরই নিতে হবে।