খেজুরিয়া মোড় পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম সোজা পথে। ঝিলিমিলি আরও ৮ কিমি দূরে। মুকুটমণিপুর থেকে এই পথ কখনও চড়াই, কখনও বা উৎরাই। সোয়া ১১টা নাগাদ এসে পৌঁছোলাম ঝিলিমিলিতে। চারপাশে হালকা জঙ্গলের মাঝে নিরিবিলিতে এখানে থাকার জন্য রয়েছে “রিমিল রিসর্ট”। আমরা ঝিলিমিলিতে না দাঁড়িয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম তালবেড়িয়া লেকে পৌঁছনোর জন্য।

ফিরতি পথে ২-৩ কিমি এসে কোরাপাড়া মোড়। এখান থেকে ডান দিকের রাস্তায় আরও ৩ কিমি দূরে জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে আছে সুন্দরী তালবেড়িয়া লেক। রাস্তা ততটা ভালো নয়, গাড়ি এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। জঙ্গলের গায়েই ছোটো এক গ্রাম। এক গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করে, দুই পাশে জঙ্গলকে সঙ্গে নিয়ে তালবেড়িয়া ড্যাম পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সুন্দর এক লেকের কাছে। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম লেকের রূপে! চারিদিকে শাল, পলাশ, শিমূল আর মহুয়ায় ঘেরা লেকটির নির্জনতাই মুখ্য আকর্ষণ প্রকৃতিপ্রেমীর কাছে।

গত কয়েক দিনের বর্ষায় লেক জলে পরিপূর্ণ। তীর থেকে সিমেন্টের (দু’পাশে রেলিং-সহ) যে সিঁড়ি লেক পর্যন্ত পৌঁছেছে, সেটারও তিনচার ধাপ জলের নীচে। সিঁড়ির শেষে সিমেন্টের ছাউনি— লেকের রূপ দর্শন ও ছবি তোলার জন্য। নীল আকাশের রঙে লেকের পরিষ্কার জলও হালকা নীল। হাতে সময় কম, তাই ইচ্ছা থাকলেও বেশি সময় থাকতে পারলাম না রূপসী ওই লেকের কাছে। ফিরে এলাম রাস্তার মোড়ে।

একজন স্থানীয় অধিবাসীর দেখিয়ে দেওয়া বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগোলাম সুতানের পথে। উঁচু-নীচু পথ, দু’পাশেই জঙ্গল। প্রথমেই এল চুরকু গ্রাম। সবুজের সাম্রাজ্যে তেমন গরম অনুভূত হচ্ছে না। চলে এলাম সুতান গ্রামে। মোটামুটি বড়ো লোকালয়। গ্রাম পেরোতেই আবার গভীর জঙ্গল সুতানের। কিছুদূর এগোতেই ‘এলিফ্যান্ট করিডর’। আরও গভীর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে কাঁচা রাস্তা এগিয়ে মিশেছে বড়ো পাকা রাস্তায়। সেই পথে বাঁ দিকে এগোলেই ঝিলিমিলি-মুকুটমণিপুরের রাস্তায় পৌঁছনো যায়।

সুতানের গভীর জঙ্গল মনে আনন্দ জাগায়। জঙ্গলের মাঝে অনেকটা ফাঁকা জায়গায় তৈরি হয়েছে নতুন এক ওয়াচ টাওয়ার এবং রাজ্য সরকার বনবিভাগের সুন্দর এক ‘অতিথি নিবাস’। বড়ো ওয়াচ টাওয়ারটি সত্যিই সুন্দর। অদুরেই দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর আগে রাজনৈতিক হামলার দুই নিদর্শন— পুড়ে-যাওয়া সিআরপিএফ-এর ছাউনি ও পুরোনো ওয়াচ টাওয়ার। নতুন ওয়াচ টাওয়ার দিয়ে উপরে উঠলে অবাক হয়ে যেতে হয়। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই গভীর জঙ্গল। অনতিদূরেই চোখ পড়বে সুতান লেক। শীতকালে বহু টুরিস্টের আগমনে লেকের জলে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা থাকে৷ হাতে সময় নেই, আজই কলকাতা ফিরতে হবে। সুতানের অরণ্য নিবাসে একটা পুরো দিন কাটাতে পারলে ভালো হতো!

দুপুর ১২টা, ফিরে চলেছি মকুটমণিপুরের পথে। বার বার উঁচু-নীচু রাস্তায় চলার পর গাড়ি এবার বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। কিছুদূর যেতেই গাড়ির ইঞ্জিন গরম হয়ে উঠেছে। ১২ মাইল জঙ্গলের মাঝামাঝি এলে রাস্তার পাশে গাড়ি থামানো হল। গাড়ির বনেট খুলে রেডিয়েটরের চেম্বারে ঠান্ডা জল ঢালা হল। মিনিট ১৫ পরে গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। রানিবাঁধ পৌঁছোলাম, কিছুক্ষণ পরেই মুটমণিপুর পেরিয়ে খাতরার পথে এগোলাম। খাতরায় পৌঁছোতে দুপুর ২টো বেজে গেল। রাস্তার পাশে এক হোটেলের কাছে গাড়ি পার্ক করলাম। হাত-মুখ ধুয়ে হোটেলে ঢুকলাম লাঞ্চ সারতে।

বাঁকুড়ায় ঢুকলাম সোয়া ৪টে নাগাদ। বাড়ি কখন পৌঁছোব কে জানে! বরজোড়া আরও ৩৪ কিমি দূরে। বেলিয়াতোড় পৌঁছোতেই দিনের আলো কমে এল। ‘তিন মাইল জঙ্গল’-এর মাঝামাঝি এসে বুম্বা গাড়ি থামাল। দেখি, আরও কয়েকটি গাড়ি এসে থেমেছে সেখানে। সকলেই ফিসফিস করছে ‘হাতি, হাতি’ বলে৷ আমিও চট করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি অকুস্থলে। একেবারে আশ্চর্য হয়ে দেখি, মাত্র ২৫-৩০ মিটার দূরে জঙ্গলের মাঝে একটু ফাঁকা জায়গায় তিনটে হাতি দাঁড়িয়ে। চোখদুটি সার্থক হতেই গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি এসে থামল দুর্গাপুর ব্যারেজের কাছে এক ধাবায়।

এনএইচ-২ তে এসে পৌঁছোলাম প্রায় সন্ধে ৬টায়। পূর্ব বর্ধমানে এসে গাড়ি আবার বেঁকে বসল। ঘড়িতে সাড়ে ৭টা বাজে, আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল। প্রায় ২০ মিনিট পরে আবার গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করা হল। ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে আমরা ডানকুনি এসে পৌঁছোলাম।

কিছু প্রয়াজেনীয় তথ্য

কীভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেনে বাঁকুড়া স্টেশনে এসে বাস বা গাড়িতে মুকুটমণিপুর। নয়তো করুণাময়ী (সল্টলেক) থেকে সরকারি বাসে বাঁকুড়া এসে, গাড়িতে মুকুটমণিপুর। সবচেয়ে সুবিধেজনক, নিজের বা ভাড়া গাড়িতে চলে আসা মুকুটমণিপুরে। দূরত্ব প্রায় ২৩০ কিমি। সময় লাগবে মোটামুটি সাড়ে ৫ ঘণ্টা।

কোথায় থাকবেন: মুকুটমণিপুরে থাকার জন্য আছে আরণ্যক রিসর্ট, ডবলুবিএফডিসি নেচার ক্যাম্প এবং পিয়ারলেস রিসর্ট। ঝিলিমিলিতে থাকার জন্য রয়েছে “রিমিল ইকো টুরিজম রিসর্ট”। সুতানের জঙ্গলে থাকার জন্য আছে রাজ্য সরকারের ‘অতিথি নিবাস’ (বন বাংলো)।

কখন যাবেন: বছরের যে কোনও সময়ে আসা যায় মুকুটমণিপুর, ঝিলিমিলি ও তালবেড়িয়া লেক দর্শনে। সুতানের জঙ্গলে বর্ষাকাল ছাড়া যে-কোনও সময়ে আসা যাবে। পুরো অঞ্চলেই গ্রীষ্মে খুব গরম। সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...