অতনুর কথা

আজ মঙ্গলবার। মনটা বড্ড খারাপ। মনে পড়ে ছোটোবেলায় মায়ের হাত ধরে কালীঘাটের কালীমন্দিরে যেতাম শনি বা মঙ্গলবারে। বড়ো হয়ে ভাবতাম ওসব কুসংস্কার, মন্দির, পুজো থেকে শত হাত দূরে থাকতাম। কিন্তু আজ ভীষণ ইচ্ছা করছে মা কালীর ওই শান্ত শীতল মূর্তির সামনে গিয়ে বসে থাকি। বলি আমার সবকিছু নিয়ে শুধু শান্তি দাও।

সকালে অফিসে প্রবাল আর অভ্র এসেছিল। প্রায় জোর করেই আমাকে নিয়ে গেল রীতেশের চেম্বারে। রীতেশ আমাদের থেকে বেশ ছোটো। কিন্তু এই বয়সেই সাইকায়াট্রিস্ট বলে নাম করেছে। সকালে ওর এক ঘন্টা খালি ছিল। ওরা কুহকিনীর সব ই-মেইলগুলোর প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছিল। রীতেশ সব শুনে বলল, এটা এক ধরনের স্ক্রিৎজফ্রেনিয়া। যারা মানসিক ভাবে দুর্বল, তাদের মনের ক্ষোভ অনেক সময় আক্রোশে পরিণত হয়।

অতনুদা, ছোটোবেলায় দেশে দেখেননি, রাস্তাঘাটে পাগল বা পাগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে— আর যাকে দেখছে গালাগালি দিচ্ছে। এটাও তাই। শুধু এক্ষেত্রে, গালাগালি দিচ্ছে ই-মেইলে। সবাইকে খারাপ কল্পনা করতে করতে একদিন কল্পনাটাই সত্যি বলে মনে হয়। তবে চিন্তা করবেন না। সবকিছুরই চিকিৎসা আছে। ফ্রাইডে ইভিনিং-এ সুচরিতাদিকে নিয়ে আসুন। কতগুলো টেস্ট করব। তবে হ্যাঁ, সময় সময় এরা কিন্তু ডেনজারাস হতে পারে। বিশেষ করে ট্রিটমেন্ট শুরু হলে। তখন এক বাড়িতে থাকা ঠিক নয়। রাত্রে যখন ঘুমোবেন তখন আপনারও ক্ষতি করে দিতে পারে। তাই মানসিক হাসপাতালে রাখতে হবে কিছুদিন। একদম ভাববেন না। এখানকার মানসিক হাসপাতাল খুব ভালো। ক’দিন পরেই দেখবেন ভালো হয়ে গেছেন।

সু মানসিক হাসপাতালে? না, অসম্ভব। প্রবালরা বোঝাল, দ্যাখ, রূপম আর সুমিত খুব রেগে আছে। ওরা চাইছিল ই-মেইলগুলো নিয়ে পুলিশের কাছে যেতে। আইপি অ্যাড্রেস থেকে ওরা লোকেট করে দেবে কোন কম্পিউটার থেকে মেইলগুলো এসেছে। তারপর তোর বাড়ির সার্চ ওয়ারেন্ট বার করতে পারলে তোদের দু’জনের হাতেই হাতকড়া পড়ত। আমরা জানি তোর কোনও দোষ নেই। তুই শুধু একটু বেশি ভালোমানুষ। বউকে সময়মতো কন্ট্রোল করতে পারিসনি। তাই আইনি ঝামেলার থেকে এটা ভালো না? আমরাও চাই সুচরিতা আবার আগের মতো ভালো হয়ে যাক। ক’দিনের তো ব্যাপার। কিন্তু সু রাজি হবে রীতেশের কাছে যেতে?

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে ওকে বললাম, ‘তোমার শরীরটা বোধহয় ভালো যাচ্ছে না, একটুতেই আজকাল মাথা গরম করো। এই শুক্রবার একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেব।”

সু খুব শান্ত ভাবে আমার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কোন ডাক্তার?’

একটু ভয়ে ভয়ে রীতেশের নাম বললাম। অবাক হয়ে দেখলাম সু রেগে গেল না। শুধু বলল ‘আচ্ছা।’

আজ বুধবার। রোজকার মতো খুব ভোরে অফিস যাব বলে তৈরি হয়ে বেরিয়েছি, দেখি গাড়িটা ড্রাইভওয়েতে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমি তো বরাবর গ্যারাজের দিকে মুখ করে রাখি। কাল কি রিভার্স করে রেখেছিলাম? মনে তো হচ্ছে না। কী জানি সু-র সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটাও বোধহয় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় স্কুল যাওয়ার সময় মা বলতেন, ‘সাবধানে যাস।’ মা তো কবেই উপরে চলে গেছেন। অথচ আশ্চর্য, ঠিক যেন ফিশফিশ করে মা-র গলা শুনলাম, ‘খোকা, সাবধানে যাস।’

অনেকদিন আগে মিহিরদার গলায় শোনা হেমন্তর একটা গান মনে পড়ল— আসব না ফিরে আর / আসব না। ফিরে কোনওদিন। মিহিরদা কী অপূর্ব গান করেন। ইশ বেচারার এখনও বোধহয় চাকরি নেই। দেশে থাকলে নামকরা গায়ক হতে পারতেন।

গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি সু এসে দাঁড়িয়েছে। ও তো এত ভোরে ওঠে না। চোখাচোখি হতে সু ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল। মুখে মৃদু হাসি। আমিও অনেকদিন আগের মতো ডান হাত বাড়িয়ে লুফে নিলাম। এই মেয়েকে আমি কী করে পাগলা গারদে পাঠাব? না না, কিছুতেই পারব না।

গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। সেই গানটা মাথার মধ্যে এখনও ঘুরছে। একেক দিন এরকম হয়। ‘যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়/ ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙে যায়। চোখের আলো নিভল যখন মনের আলো জ্বেলে/একলা এসেছি আমি, একলা যাব চলে।’

সু এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ও কি বুঝতে পেরেছে আমরা কী প্ল্যান করছি? উঃ ভগবান! এই দোটানা থেকে আমায় মুক্তি দাও, মুক্তি দাও।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...