বাগানের কাঠের দরজাটা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই স্যাঁতসেঁতে গন্ধটা নাকে ঢুকল। বাগানের আলোটাও জ্বলেনি। অন্যদিন তো পড়িয়ে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আলো নেভানো হয় না, অন্তত এই গ্রীষ্মকালে তো নয়ই। তাহলে কি আজ আলোটা জ্বালাতেই ভুলে গেছে। নাকি মায়ের শরীরটা আচমকা খারাপ হয়ে গেছে, দিদিও ভুলে গেল। বাগানের ভিতর দিয়ে যাবার সময় কথাগুলো মাথার ভিতরটাকেও নাড়িয়ে দিল।
বারান্দার দরজা খুলে একটু জোরেই বলে উঠল, “মা…! কোথায় গো? দিদি, এই দিদি…’ কোনও সাড়া নেই। বারান্দা এমনকী ঘরের আলোটাও কেউ জ্বালেনি। এমনটা তো কেউ করে না। অন্তত একটা ঘরের আলোও জ্বেলে রাখে। অর্পিতা গ্রিলের দরজা খুলে আস্তে আস্তে বারান্দা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। আলোটা জ্বালাতে জ্বালাতেই বলে, ‘কি রে দিদি, লাইট জ্বালিসনি কেন?’ কোনও উত্তর না পেলেও আলোটা জ্বালতেই চমকে ওঠে। বিছানার এক কোণে মা শুয়ে আর তার পাশে দিদি বসে। দুজনেই বিপর্যস্ত। অর্পিতা ঘরের চারদিকটা একবার দেখে নেয়।
এদিক ওদিক জিনিসপত্র ছড়ানো ছেটানো রয়েছে। টেবিলে থাকা বাবার ছবি, পুরোনো রেডিও, মায়ের, দিদির কয়েকটা শাড়ি, নিজেরও কয়েকটা পোশাক, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অর্পিতা চারদিকটা দেখে দিদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “দাদা এসেছিল?’ কোনও উত্তর না পেয়ে একটু জোরে বলে ওঠে, ‘কিরে, উত্তর দিচ্ছিস না যে?”
—কী উত্তর দেব, সবই তো জানিস, কে আসে, কেন আসে?
ঘন্টা দুই আগে দিদি ফোন করে মায়ের প্রেসারের ওষুধটা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলে, ফেরবার সময় খোঁড়াদার দোকান থেকে ডিম আনার কথাও বলে। তখন তো দাদার ব্যাপারে কিছু বলেনি। ডিমের প্রসঙ্গে অর্পিতা বরং বলে ওঠে, দিদিরে মাসের শেষ এখন কিন্তু জোড়া ডিম আনতে পারব না, একটাই নেব। খোঁড়াদার দোকানে আর যাব না এখুনি বকবক করবে। দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করবে, ‘একটা কেন? দু’বোন তো৷’ বড়ো প্রশ্ন সবার।
দিদি মজা করে উত্তর দেয়, ‘তোকে পছন্দ করে তাই!”
—চুপ কর, পছন্দ না হাতি। বলে ফোনটা কেটে দিতেই মনের ভিতর খোঁড়াদা চলে আসে। ছোট্ট গুমটি, লজেন্স, বিস্কুট, পান বিড়ি, পাঁউরুটি, ডিম— এসবের দোকান। বছর
চার-পাঁচ করেছে। কলেজে খুব ভালো ছাত্র ছিল। রাজনীতি করত, কারা নাকি গাড়ি নিয়ে বাঁ পা-টাকে চেপে দেয়। হাঁটুর নীচ থেকে পা-টা বাদ দিতে হয়। তারপর থেকেই সবাই খোঁড়া বলেই ডাকে৷ অর্পিতা দোকানে গেলেই বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করে। তবে কোনওদিন কোনও খারাপ ইঙ্গিত করে না, খারাপ কথাও বলে না।
অর্পিতা কলেজে পড়বার সময় বেশ কয়েকটা ছেলে পিছনে ছিল, কলেজের বাইরে আবির ছিল। আবির আবার সেই সময় কলেজের এক সিনিয়র দাদার বন্ধু। কলেজ ফেস্টে আলাপ হবার পরে বেশ মেলামেশা হয়। তবে খুব বেশি দূর এগোনোর আগেই আবির কোনও কিছু না বলে কোথায় চলে যায়। আবিরের কথা বেশি ভাবার আগেই বাবা মারা যায়। যদিও চাকরি থেকে রিটায়ার করে গেছিল, তাও পেনসনটাতো ছিল। স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও, চলে যাওয়ার মতো।
বাবা মারা যাওয়ার পরেই স্বাভাবিক ভাবে মায়ের প্রাপ্ত অর্ধেক পেনসনের টাকায় সংসারের গতি কমতে লাগল। সেই সঙ্গে নতুন আরেক উপদ্রবও চলে এল। বাবার কাজের সময় দাদা বড়দি আর জামাইবাবু কথা প্রসঙ্গে একটা প্রছন্ন ইঙ্গিত দিতে আরম্ভ করেছিল, “না, মানে পেনসনে এখন আইনত মায়ের সঙ্গে তোমার বড়দি, দাদা, এমনকী তোমাদেরও সমান ভাগ আছে।”