বাংলার ছবিতে যখন গোয়েন্দার অভাব নেই, ঠিক সেই সময় একজন নতুন গোয়েন্দাকে বড়োপর্দায় হাজির করলেন অঞ্জন দত্ত। প্রায় তিন বছর পর প্রেক্ষাগৃহে এল তাঁর নতুন সিনেমা ‘রিভলভার রহস্য’ । গল্পের সূত্র তাঁর নিজের লেখা বই, যা কিনা এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে৷ নতুন এই গোয়েন্দা ফ্র্যাঞ্চাইজি পরিচালক অঞ্জন দত্তের কাছে এক বড়ো চ্যালেঞ্জ। এর আগে ওয়েব সিরিজ়ে পা রেখেছে সুব্রত। এই প্রথম অঞ্জন তাকে নিয়ে এলেন বড়ো পর্দায়। তাই ‘রিভলভার রহস্য’ নিয়ে কৌতূহলীদের আগ্রহ থাকটা স্বাভাবিক।
বৃষ্টিভেজা দার্জিলিং শহর বারবার জায়গা করে নিয়েছে অঞ্জনর ছবিতে।এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না৷ গল্পের ষুরুতেই জানা যায়, এক নিখোঁজ মহিলাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সুব্রত। একের পর পর এক রহস্যের জাল সরতে থাকে। গোয়েন্দা সুব্রত শর্মা। কাকে বিশ্বাস করবে সে?
শুরুতে একটা চমৎকার চেজ সিকোয়েন্স রয়েছে। দার্জিলিংয়ের খাড়াই গলিঘুঁজি, সর্পিল পথ পেরিয়ে অপরাধীকে ধাওয়া করছে সে। মার খাচ্ছে, পালটা দিচ্ছে, আবার হারছে। দুরন্ত সম্পাদনার গুণে দৃশ্যটা আবার ফিরে আসছে ছবিতে। তখন বোঝা যায় দার্জিলিং কেন পরিচালকের অনিবার্য অন্বেষণ।
ভূত আর রক্তমানুষের সত্যসন্ধানীর যুগলবন্দি খুবই ইন্টারেস্টিং! সুব্রত এক সময় ছিল ক্রাইম রিপোর্টার, চাকরি হারিয়ে হয়েছে টিকটিকি। ‘ড্যানি ডিটেকটিভ আইএনসি’ চালাত সে-ই। ওয়েব সিরিজ় ‘ড্যানি ডিটেকটিভ আইএনসি’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ড্যানি বা সুব্রত সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানেন। যাঁরা দেখেননি, তাঁদেরকে সূত্রটা একটু ধরিয়ে দেওয়া উচিত। ‘বস’ অর্থাৎ ড্যানির গোয়েন্দা সংস্থাতেই সুব্রত চাকরি করে। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে ড্যানি খুন হয়েছে। ফলে এক দিকে রুগ্ন এজেন্সি। অন্য দিকে, ড্যানির স্ত্রীর অফিস বিক্রির শাসানি, সবটাই সুব্রতকে একা হাতে সামলাতে হয়। রয়েছে তার বোন রত্না (তানিকা) আর মৃত বসের স্ত্রী মালা (সুদীপা)। এমন সময় তার কাছে একটা কেস আসে, ব্যবসায়ী রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (সুজন নীল) নিখোঁজ স্ত্রী তমালিকে (তনুশ্রী) খুঁজে বের করার জন্য।
‘ড্যানি ডিটেকটিভ আইএনসি’-র গোয়েন্দা সুব্রত শর্মাকে নিয়ে তিনি এর আগে সিরিজ করেছিলেন তবে এবারে সম্পূর্ণ নতুন গল্প নিয়ে তাঁর সিনেমা। লেখার ধরন ‘পাল্প ফিকশন থ্রিলার’ গোছের। এই গোয়েন্দা সর্বার্থেই ছকভাঙা। ডিটেকটিভ বলতে আমরা যেমন বুঝি প্রখর ধীশক্তি সম্পন্ন। প্রবল তার পর্যবেক্ষণ শক্তি, মাছিও গলতে পারবে না তার নজর এড়িয়ে। তার এক সহকারী থাকবে, যে বুদ্ধিতে খাটো হবে এবং প্রধান গোয়েন্দা তাকে দাবড়ে রাখবে।
না, অঞ্জনের সুব্রত (সুপ্রভাত দাস) তেমন নয়। ছ’ফুট লম্বা নয়, সে কোনওদিন ডিটেকটিভ হতেও চায়নি। উত্তর কলকাতার রকে বসা, পাড়ায় চায়ের দোকানে ম্যাজিক দেখানো, গলি ক্রিকেটে হাত পাকানো, অল্প-স্বল্প ঢপ মারা সাধারণ মানুষের মতোই সে। আর সুব্রত তার সহকারীকে দাবড়ে রাখবে কী, উল্টে তার সহযোগী ড্যানি ব্যানার্জি-ই (অঞ্জন) ধমকায় তাকে। যদিও সেই ড্যানি মারা গিয়েছে একটা কেস সলভ করতে গিয়ে। কিন্তু ছেড়ে যেতে পারেনি সুব্রতকে। এখনও তাকে গাইড করে বস ড্যানি। সর্বক্ষণ তার ঘাড়ে চেপে থাকে! শুধু ঘাড়টা মটকায় না! সে নির্দেশ দেয় নেপথ্যে থেকে আর বিপদের ঝুঁকি নেয় সুব্রত।
আনাড়ি হলেও তার অল্টার ইগোর মতো ড্যানিকে সঙ্গে নিয়ে সুব্রত নেমে পড়ে রহস্য সমাধানে। রহস্য ঘনায় দার্জিলিংয়ের স্যাঁতসেঁতে কুয়াশায়।রাজা ব্যানার্জি (সুজন নীল মুখোপাধ্যায়) নামক কলকাতার এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী মালতী নিখোঁজ। পরকীয়া সম্পর্কের জেরে স্বামীকে ছেড়ে চলে গিয়েছে স্ত্রী। পুলিসে খবর দিলে লোকলজ্জার আশঙ্কা। তাই ডিটেকটিভ এজেন্সির শরণাপন্ন হয় রাজা। কিন্তু, ড্যানি তো নেই। অগত্যা, কিছুটা মিথ্যের আশ্রয়েই কেসটা হাতে পায় সুব্রত।
এ ছবির দার্জিলিং অঞ্জনের আগের ছবিগুলোর থেকে একদম আলাদা। ক্যামেরার দায়িত্ব সুন্দরভাবে সামলেছেন প্রভাতেন্দু মণ্ডল। নীল দত্তর সুরে অঞ্জনের কণ্ঠে ‘পুরনো চাঁদ আমার এখনও আকাশে’ ছবির শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি৷ অ্যাকশন, মজা, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ সব মিলিয়ে ছবি জমে যায়। রিভলভার আর বুলেট গল্পের মজ্জায় মিশে। । ক্লাইম্যাক্সে টুইস্ট আছে, চক্রান্ত আছে। তবে ছবির শেষটা অবিশ্বাস্য লাগে। কিন্তু সিনেমায় তো এমন হয়ই!
ব্যবসায়ীর চরিত্রে সুজন নীল মুখোপাধ্যায়ের পরিণত অভিনয় ভালো লাগে। তনুশ্রী চক্রবর্তী এবং শোয়েব কবীরও মন্দ নন। অভিজিৎ গুহ, কাঞ্চন মল্লিক, সুদীপা বসু এবং তনিকা বসুর চরিত্রগুলোক ক্যামিয়ো বলা চলে। থ্রিলারকে মাথায় রেখে প্রভাতেন্দু মণ্ডলের ক্যামেরা বেশ কিছু ভালো দৃশ্য উপহার দিয়েছে। অর্ঘ্যকমল মিত্রর সম্পাদনা যথাযথ।
এই ছবিকে ঠিক ‘হু ডান ইট’ ছকে বাঁধতে চাননি পরিচালক। ফলে ছবি জুড়ে কৌতূহল যে একমাত্রায় রয়েছে, তা নয়। তবে প্রচুর চমক রয়েছে। আবার সেই চমক যে সব ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে তা নয়।
সুব্রত যে ফেলুদা বা সোনাদার মতো শুধুমাত্র ছোটোদের জন্য তৈরি নয়, সে কথা অঞ্জন আগেভাগেই জানিয়েছিলেন। বাঙালি গোয়েন্দাদের ভিড়ে নতুন সংযোজন। ফলে আগামী দিনে সুব্রত আলাদা করে তার নিজের দর্শকবৃত্ত তৈরি করে নেবে, আশা করাই যায়।