স্কুলে মেরি গো রাউন্ড খেলার সময় জোরে ঘুরতে ঘুরতে নীপা বলল, ‘জানিস তিতু বাড়িতে নীলুমামা আর মামি এসেছে সুইজারল্যান্ড থেকে।’

—ওমা তাই!

স্কুল ছুটির পর নীপা আমায় টানতে টানতে ওদের বাড়ি নিয়ে এসেছে। এসে দেখি পুরো চাঁদের হাট। ওদের ড্রইং রুমে কার্পেটের ওপর হাট করে বিশাল সুটকেস খুলে সুইস চকোলেট-সহ বিভিন্ন গিফট বিলি করছে মামি। নীপার প্রিয় বন্ধু আমি, আমাকেও আদর করে চকোলেট আর সুইস গ্রিটিংস কার্ড দিলেন মামি। আমার খুব লজ্জা করলেও নিলাম। সেই কার্ডখানা এখনও আছে।

পড়াশোনা শেষ করে পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের জীবন তৈরিতে লেগেছি। নীপার বিয়ের ঘটকালি করতে গিয়ে নিজেও নীপার বর সায়নের ইঞ্জিনিয়র বন্ধু দেবদূতের প্রেমে ধপাস হলাম। প্রেম বিবাহ সবই হল। চাকরি সূত্রে এবং ভ্রামণিক হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তরে ঘুরে বেড়ালেও, সুইজারল্যান্ড যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। অনেকদিন পরে মুম্বই থেকে হ্যালির ধুমকেতুর মতো নীপার ফোনকল— ‘হঠাৎ করে ডিসিশন হল রে, নিউ জবে জয়েন করে কয়েক বছরের কনট্র্যাক্টে সায়ন সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। বুঝতেই পারছিস এতটা বিরহ সহ্য হবে না, তাই আমিও তল্পি গুছিয়েছি। শোন তিতু এবার আর মিস করিস না। আমরা থাকতে থাকতেই দেবদূতকে তুলে নিয়ে চলে আসিস বেড়াতে।’

শুনে রিফ্লেক্সে চিৎকার করে বললাম, ‘নীপা তুই সুইজারল্যান্ড চলে যাচ্ছিস!’ ব্যস ততক্ষণে ফোন কাট।

এরপর বছর দেড়েকের মাথায় দেবদূতের কোম্পানির ইন্টারন্যাশানাল কনফারেন্সের ভেনু হল জেনেভাতে। আমি তো ওৎ পেতেই ছিলাম ছিপ ফেলে বঁড়শিখানা গেঁথে ফেললাম জেনেভা কনফারেন্সে —ওরফে সুইজারল্যান্ডের বুকে। শুরু হল জেরা। শুধু শ্বাশুড়ি মা কেন? আমার জন্মদায়িনীও তো কম যান না! পুরো ফ্যামিলি অ্যাটাক— ‘তিতু কী করে একা একা যাবি? দেব যাবে জেনেভা, তুই যাবি জুরিখ? ব্যাপারটা কি একটু খোলসা করে বলা যাবে ?*

—হোয়াট? এক প্লেন ভর্তি লোকের সাথে যাব আমি। সেন্ট্রাল গর্ভমেন্ট-এর সার্ভিলেন্সের একটা পাকাপোক্ত চাকরি করি মা। ছুটি ম্যানেজ করতে পারলেই ট্রেক করতে চলে যাই পাহাড়ে। বাইশ বছরের একমাথা সিঁদুর দেওয়া নতুন বউ নই যে কেউ ইলোপ করবে!

শ্বাশুড়ি চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুমি তো সব সময় সাজুগুজুর আউটফিটে থাকো, অন্যের নজর লাগে।’ বিভিন্ন ধরনের হার্ডেলস আসলেও রাতের টুনি টুনি আঁধারে, দেবের সাথে মসৃণ স্লগ ওভারে ম্যাচ খেলে জিতে সোজা জুরিখের টিকিট কেটে তবে থামলাম। এই তো জীবন কালীদা। কার জন্য যে কী নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখা, কেউ জানতি পারে না!

নীপা আর সায়নও লেগে পড়ল তাই দেবদূত বাবাজিকে রাজি হতেই হল। জেনেভা কনফারেন্স শেষ করে পুষ্পক রথে চড়েই না হয় দেবদূত আমাদের জুরিখ টিমে জয়েন করবে।

বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ভায়া দিল্লি হয়ে প্লেন যখন জুরিখের মাটি সত্যিই চুল, জানলা দিয়ে চোখ মেলে দেখি অদেখা স্বপ্নের দেশে কেবল নির্ঝরের স্বপ্নের ওড়াউড়ি।

একটু আউটস্কার্টে নীপাদের ছোট্ট কাঠের বাড়ি এবং পেছনদিকের অগোছালো বাগানটা অপূর্ব। বাগানের শেষ দিকে একটা ছোট্ট ক্রিক আছে। আমি প্রায়ই ওটার ওপর দাঁড়িয়ে চা খাই, রাত সাড়ে ন’টার সময় আবাক হয়ে সূর্যাস্ত দেখি। এখন সামার চলছে তাই সবদিকে বসন্ত বাহারের রাগমালা। নীপা, সায়ন আমায় নিয়ে ঘুরে দেখাল বেশ কিছু জায়গা। নীপা একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট। এদেশে তো কেউ হাত পা নিয়ে বসে থাকে না, সবসময়টা কাজে লাগায়।

আমার ভ্রমণের ডায়ারিতে করে আসা হোমওয়ার্ক থেকে ক’টা জায়গা বাদ পড়ছে যেগুলো আমি চাইলে নিজেই ঘুরে আসতে পারি। নীপা আর সায়ন দুজনেই তো আমার জন্য লাগাতার ছুটি নিয়ে কেরিয়ার-কে বানপ্রস্থে পাঠিয়ে গাইড হয়ে যেতে পারে না! কারণ পরবর্তী পর্যায়ে দেব আসলে তার জন্য ছুটি মজুত রাখতে হবে।

আমি বাড়িতে বসে একা একা কী করি কী করি? তাই এখানেও সেই সেটিং করতে হল। বললাম— ‘সায়ন, নীপা ডোন্ট বি সিলি! আমার পঁয়ষট্টি বছরের মাসি একদম একা একা জার্মানির অর্ধেকটা নিজে ঘুরে তবে মেয়ে জামাইয়ের কাছে গেছেন গতবছর। আর মাত্র তিনটে দিন আমি এই কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে আসতে পারব না!”

সায়ন কাঁচুমাচু মুখে বলল, “পঁয়ষট্টি বছরের মাসি আর তুমি কি এক হলে? দেবদূত শুনলে কী বলবে তিতু? সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

—দেব জানবে না সেই ব্যবস্থা করো না বাপু। মনে হচ্ছে আমি সুইজারল্যান্ড নয় উগান্ডা বেড়াতে এসেছি। চারিদিকে সিংহ, বন্য জন্তুর ভয়। তোমরা আমায় ভালো এজেন্সি দিয়ে হোটেল বুকিং, বাস বুকিং করে দাও ব্যস।

সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ শুরু করেছি জুরিখ শহরের বনেদি পথ ধরে। খ্রিস্টপূর্ব পনেরো শতকে রোমানদের হাতে এই শহর গড়ে ওঠে। রাস্তাঘাট, মানুষের সভ্য ব্যস্ততা, লেকের জলের শহরের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হচ্ছে স্বাধীনতার বর্ণময় পাখা সমগ্র শহরটিকে ছায়া দিয়ে রেখেছে।

জুরিখ সরোবরে বোটিং এবং লেক ক্রুজের ব্যবস্থা অনেকটা ফেলো কড়ি মাখো তেল গোছের। পকেটের রেস্ত অনুযায়ী শহরে বিচরণের জন্য হুডখোলা লাল ট্রামের টিকিট কাটলাম। আমি কলকাতার বাসিন্দা, নিত্যদিন রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের লড়াইয়ের ধকল সামলেই যাতায়াত করতে হয়— তা সে সেডানেই হোক বা অটোতে। সেই রিফ্লেক্স আমার আজন্মের সহজাত। ক্ষিপ্রতার সাথে ট্রামে উঠে একপাশের প্রথম সিটের দখল নিলাম কিন্তু বসে মনে হল কেন করলাম এই অহেতুক আচরণ! একটু লজ্জা করল। বাকি সবাই কী সুন্দর ধীরেসুস্থে উঠে সিটে বসল। ঘন্টি বাজিয়ে লাল সাদা ট্রাম ছুটতে শুরু করল তার নির্দিষ্ট আউট লাইনে। মাইক্রোফোনে রাস্তার নাম এবং দ্রষ্টব্য স্থান বলা হতে লাগল। ছবির মতো সুন্দর জুরিখের ছায়া, তার মায়ার কাজল পরিয়ে দিচ্ছে চোখে। জুরিখ লেকের কোলে ফিরে এলাম একটা স্বপ্নের ট্রাম সফর শেষ করে।

নিয়ম মেনে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে ক্রুজে উঠতে যাব হঠাৎই একটা ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার ডান হাঁটুটা ক্রুজে ওঠার কাঠের রেলিং-এ সজোরে ঠুকে গেল। আমার মুখ দিয়ে উফ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা মোলায়েম সুরের ‘সরি এক্সট্রিমলি সরি’ বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে মাটিতে ছিটকে যাওয়া ব্যাগ ম্যাপ সব তুলে দিল একটি লম্বা ছেলে। উষ্ণ অভ্যর্থনায় হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ডিলান ম্যাটিয়া ফ্রম ইটালি।’

আমিও হাত ঝাঁকিয়ে প্রত্যুত্তর দিলাম— ‘তিতাস রে ফ্রম টেগোরস কান্ট্রি ইন্ডিয়া।” আমাকে তস্য অবাক করে দিয়ে ডিলান হাতজোড় করে বলল, ‘নমস্তে, ভারত মাতাজি।’

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...