২য় পর্ব
—এ কি! তুমি এত সাজগোজ করে জামা-কাপড় পরে বসে আছ কেন? কোনও অনুষ্ঠানে যাবে বুঝি?
কথার উত্তর না দিয়ে শ্রী বিতানকে জাপটে ধরে খাটে বসিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘কেন আমাকে দেখতে যথেষ্ট সুন্দর লাগছে না বুঝি? দ্যাখো… দ্যাখো… দ্যাখো ভালো করে। তোমার জন্যই তো সাজলাম। এগুলো কেরালার গয়না, জানো? বাবা কেরালার কান্নুরে পোস্টেড ছিলেন। তখন কিনে দিয়েছিলেন এগুলো।’ বিরক্ত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় বিতান।
—আঃ শ্রী! কী যে ছেলেমানুষি করো না! তোমাকে তো রোজই দেখছি। আমার জন্য এত সাজগোজ করবার তো কিছু নেই! বিতানের আরও কাছে এগিয়ে এসে তার বুকে মুখ গুঁজে শ্রী বলে ওঠে, ‘উঁহু, অনেকক্ষণ দ্যাখোনি তো আমায়। সারাটা দিন। মানে ঠিক আট ঘন্টা, ত্রিশ মিনিট, দশ সেকেন্ড।’ শ্রীর আলিঙ্গনে বিরক্তি যেন জাপটে ধরে বিতানকে।
—আঃ ছাড়ো এখন! সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরেছি। এখন বড্ড ক্লান্ত, শ্রী। কোথায় চা, জলখাবার দেবে তা নয়… কী যে করো না এসব!
ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে চলে যায় বিতান। পিছনে শ্রীদর্শিনীর মাথায় যে নীরবে ভিসুভিয়াস ফুটছে, তা বেশ বুঝতে পারে সে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের ঘরে ঢোকে বিতান। দেখে মা শরৎকাহিনিতে মগ্ন। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। এতক্ষণ মনে যে-ক্ষোভ, বিরক্তি জমেছিল পুরোটা উগরে দিল মায়ের উপর।
—বেশ ভালোই আছো তোমরা। একজন সাজগোজে বিভোর, আর একজন কাব্য-কাহিনি পড়তে ব্যস্ত। বাহ্! আমি যে সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে এসেছি সে দিকে কারও নজর নেই। বিতান দেখল ছায়া ঘনিয়ে এল মায়ের মুখে। লজ্জিত মুখে মা বলল,
—এইমাত্র সব সেরে এসে একটু বসলুম রে, বাবা। ওবেলার রান্নাটাও সেরে নিলুম। রাতে শুধু গরম গরম ভাত নামিয়ে খেতে দেব তোদের। তা এখন জলখাবারে কী দেব, বল?
গজগজ করতে করতে বিতান বলে, ‘কেন? একা সব কাজ করো কেন? তোমার আদরের বউমাটিকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেও তো পারো! শেখালে কি সে শিখবে না?’ মায়ের মুখটা যেন আরও কালো হয়ে যায়। মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আসলে সে তো এ সংসারের নতুন মানুষ। এখন একটু সাজগোজ-আমোদ-আহ্লাদ করুক না মেয়েটা। ক’দিন পরে তো সংসারের জোয়ার কাঁধে নিতেই হবে। যাক গে, তোকে একটু মুড়ি মেখে দিই, শসা-পেঁয়াজ দিয়ে?’
—নাঃ, শুধু চা আর বিস্কুট দাও। বলেই গট গট করে ড্রয়িংরুমের দিকে হেঁটে যায় বিতান। যেতে গিয়ে আড় চোখে শোবার ঘরের দিকে তাকায়। সেখানে যেন কঠিন নীরবতা বিরাজ করছে! আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাষ! টিভিটা চালিয়ে অস্থির ভাবে চ্যানেল ঘোরাতে থাকে বিতান।
মা কিছু না বললেও বিতান জানে সারাদিন রূপচর্চায় মত্ত থাকতে চায় শ্রীদর্শিনী। নানারকম রূপটান বা ফেসপ্যাক, হেয়ার প্যাক তৈরির উপকরণ বিতানই তো কিনে আনে শ্রীর ফরমায়েশ অনুসারে।
সকালে উঠে এক কাপ ঈষদুষ্ণ জলে একটা পাতিলেবু আর এক চামচ মধু মিশিয়ে খায় শ্রী। তারপর মুসুরডাল বাটা আর হলুদ দিয়ে একটা প্যাক তৈরি করে মুখে লাগায়। শেষে ঈষদুষ্ণ নারকেল তেলে এক চামচ লবঙ্গ তেল মিশিয়ে ভালো করে স্ক্যাল্পে মাসাজ করে। প্রায় দিনই বিতান দেখে বাড়িতে লবঙ্গ তেল তৈরি করে শ্রী।
লবঙ্গ, মিক্সার গ্রাইন্ডারে গুঁড়ো করে নারকেল তেলে মিশিয়ে একটা কাচের বোতলে ঢেলে খাটের নীচের অন্ধকারে রেখে দেয় এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ পর মসলিন কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে সেই তেল মাথায় লাগায়। বিতান লক্ষ্য করে শ্রীর এইসব রূপচর্চা ও তার উপকরণ তৈরি করা শেষ হতে হতে মায়ের একটা ভাজা, মাছের ঝোল, ডাল নেমে যায়। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু ও বিরক্তিকর লাগলেও নতুন বউকে কড়া ভাবে কিছু বলতে পারে না সে।
কিছুক্ষণ পরে শোবার ঘরে ঢুকে মনটা ভারী হয়ে ওঠে বিতানের। দেখে ঘরের সারা মেঝে জুড়ে গয়নাগাটি, মেক-আপের জিনিস ছড়ানো। লিপস্টিক, আইলাইনারগুলো ভেঙে কুটিকুটি করে ফেলেছে। আর বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শ্রী। কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখে বিতান। শ্রীর কান্নার তোড় আরও বাড়তে থাকে। মনে মনে অনুশোচনা হতে থাকে বিতানের। এতটা আঘাত না দিলেও হতো মেয়েটাকে। না হয় একটু সেজে তাকে দেখাতেই এসেছিল। একটু অবুঝ মা মরা মেয়েটা, বাবার আদরের। বুঝিয়েসুজিয়ে বললে নিশ্চয়ই একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। আদর করে শ্রীকে কাছে টেনে নেয় বিতান। শ্রীকে যে সত্যিই সে ভীষণ ভালোবাসে।
কিন্তু কিছুই ঠিক হল না। নিজের রূপচর্চা-সাজগোজ আর বিতানকে ঘিরে শ্রীর ভয়ংকর অবসেশন দিনের পর দিন বাড়তেই লাগল। সবসময় শ্রীর এক অমূলক ভয় যে, সে দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর বিতান অন্য মেয়েদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে…
—পুজোর দিনগুলোতে নিজের সাজপোশাকে সেরাটা দেওয়া মাস্ট। ভিড়ের মাঝে, বিশেষ করে তোমার অফিসের বিশ্বকর্মা পুজোর দিনের ওই গেট টুগেদারে নজর কাড়তে গেলে পোশাকের কালার, কাট, ফ্যাব্রিক সব হতে হবে একদম এক্সক্লুসিভ। জানো? কীভাবে সাজতে হবে ও ঘরোয়া রূপচর্চার নানা গাইড লাইন দিচ্ছে বহু প্রিন্টেড ও অন-লাইন ফ্যাশান ম্যাগাজিনগুলো। নেইলপলিশ পরতে পরতে এক নাগাড়ে বলে চলে শ্রী।
—সেবার তুমি অফিসের কম্পিউটার সেকশানের মৃদুলার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছিলে। সেবন্তীর সঙ্গে তোমার সে কী হাহা হিহি! এবার আমি আর কোনও রিস্ক নেব না বাবা। এবার আমার ড্রেস হবে এক্কেবারে হটকে! আর জানো তো আজকাল পুরো মুখের সাজে একই রঙের আধিক্য। এই মনোক্রোম মেক-আপ এখন রীতিমতো ভাইরাল।
শ্রীর স্বরে যেন একেবারে কোনও ক্লান্তি নেই! শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায় বিভানের।
—জীবনটা শুধু সাজগোজ আর গয়নাগাটি নয়, শ্রী। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো লক্ষ্মীটি! এ তো মানসিক অসুখ! চলো তোমাকে নিয়ে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই। তিনি হয়তো তোমাকে কোনও ভাবে হেল্প করতে পারবেন।
—কী বললে? আমি পাগল? আমি পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব? হাউ ডেয়ার ইউ! রাগে হাতের কাছে যা থাকে বিতানের দিকে ছুড়তে থাকে শ্রী!