দোকানে বসে থাকা লোকগুলো দেখবে, কালো জানলার সবুজ পর্দায় ছায়া পড়ছে। বোঝা যাবে, ভেতরে দাঁড়িয়ে ছেলেটা জামা খুলছে, গেঞ্জি খুলছে, সিগারেট ধরাল। মেয়েটি পাশে এসে দাঁড়াল। শাড়ি খুলছে, নাইটি পরল। মাথার খোঁপায় হাত দিল, চুল খুলছে। ছেলেটা আরও পাশে সরে এল। মুখ রাখল মেয়েটার বুকে— সব পরিষ্কার দেখা যায়। পাড়ার ছেলেরা বলে রামুর দোকানের ইভিনিং শো। এটা দেখতেই বুঝি ওর দোকানের খদ্দের বেড়ে গেছে। সন্ধে হলেই ভিড় লেগে যায়।
কোনও কোনও দিন একটা তৃতীয় ব্যক্তির ছায়াও দেখা যায়। ছায়াটা নড়ে না। যতক্ষণ আলো জ্বলে, স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। পর্দার একপাশে। ওই লোকটা কে? কখন আসে ওদের বাড়িতে? কাউকে তো আসতে দেখা যায় না!
রাত হলে প্রতিবেশিনী শুনতে পায় মেয়েটা বলছে,
—পর্দাটা পালটাতে হবে।
—কেন?
—এটা দিয়ে সব দেখা যায়! দেখতে পায় লোকে।
—দেখুক না! ক্ষতি কী?
—ক্ষতি নেই?
—না। আমরা তো খারাপ কিছু করছি না।
—তা হোক, আমার কেমন লাগে। তুমি অন্য পর্দা কেনো।
—কেন ছায়া? মনোময়ের হাসি শোনা যায়, সবুজ রং তোমার ভালো লাগে না?
—এটা আমি খুলে ফেলব। যখন হাওয়ায় এটা দোলে, মনে হয় না, তোমাকে কেউ ডাকছে?
পরের দিন শোনা যায় ছেলেটি বলছে, ‘রাগ করেছ ছায়া? কাছে এসো।’ মেয়েটি সাড়া দেয় না।
—তোমার শরীরটা কি সুন্দর ছায়া!
প্রতিবেশিনীর নিশ্বাস ঘন হয়। জানলায় কান চেপে ধরে। ছেলেটির কথা শুনতে পায়।
—তোমাকে আদর করতে করতে মনে হয় আমি পুড়ে যাচ্ছি।
—বাজে কথা বোলো না।
—বাজে কথা নয় ছায়া। তোমাকে যখন থেকে ছুঁয়েছি, আমার শান্তি হারিয়েছি! আমি পুড়ছি!
—সেটা আমার দোষ?
—দোষ দু’জনের। মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো?
—কী?
—মনে হয় এই আগুনটা পুরো নিভিয়ে ফেলি। তোমার মনে হয় না?
—চুপ করো। ঘুমিয়ে পড়ো।
—ঘুম! ঘুম কোথায় ছায়া। চোখ বুজলেই যে মনে হয়, তুমি যদি চলে যাও। স্বপ্নের মতো তুমি আমার জীবনে এসেছিলে, যদি স্বপ্নের মতোই হারিয়ে যাও।
—আমি কোথাও যাব না সোনা!
—বিশ্বাস কী? তোমার গলাটা কি সুন্দর ছায়া। কেমন পালকের মতো পাতলা৷
—এত জোরে চাপ দিচ্ছ কেন? আমার লাগছে।
—কেন ছায়া, ভালো লাগছে না? তুমি তো বলতে আমি তোমাকে যেমন সুখ দিই, ও দিতে পারে না।
—ছাড়ো আমার গলা। আমার লাগছে।
—যদি আর একটু জোরে চাপ দিই ছায়া আগুন নিভে যাবে। যাবে না?
প্রতিবেশিনীর গায়ে কাঁটা দেয়, জানলা থেকে সরে আসে।
ঠিক রাত ন’টায় ওদের ঘরের আলো বন্ধ হয়ে যায়। রামুর দোকানও খালি হয়ে যায়। তারপর কেউ যখন থাকে না, ওরা দু’জন আসে চা খেতে। বেঞ্চের কোণ ঘেঁষে বসে। অন্ধকারে দুটো ছায়ার মতো। রামু নতুন করে কেটলিতে জল চাপায়। দু’চামচ দুধ বেশিই দেয়। নিভে আসা আগুনটা লোহার শিক দিয়ে খুঁচিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে বলে, ‘থাক আজ দাম দিতে হবে না।”
—কেন রামুকাকা?
—এমনিই।
—তুমি আমাদের ভালোবাসো, তাই না রামুকাকা? —হ্যাঁ, আপনাদের দেখলে আমার মায়া হয়। শব্দ করে হেসে ওঠে দু’জনেই।
—কেন রামুকাকা?
—জানি না। তবে আপনাদের দেখে মনে হয় আপনারা ভালো নেই!
—এবার ওরা আর হাসতে পারে না ।
মাঝে মাঝে হয়তো ছেলেটা বলে, ‘রামুকাকা, তুমি কতদিন হল দোকান করছ? অনেকদিন?
—হ্যাঁ দাদাবাবু, তা বিশ বছর তো বটেই।
—সে তো অনেকদিন। তখন নিশ্চয়ই এখানে এত বাড়ি ঘর ছিল না?
ক্রমশ…
অঙ্কনঃ লেখক