দীর্ঘদিনের দাক্ষিণাত্য যুদ্ধে ঔরংজেব যখন চরম আর্থিক অনটনের মধ্যে, বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের প্রায় সব অঞ্চল থেকে যখন দিল্লিতে অনুপস্থিত সম্রাটকে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ— তখন শুধু করতলব খাঁ-ই বাংলার রাজস্ব বিভাগ সংস্কার করে দিল্লির অসহায় সম্রাটকে নিয়মিত রাজস্ব পাঠিয়েছেন। সেই সময় বাংলার রাজধানী ছিল জাহাঙ্গীরনগর (বর্তমানে ঢাকা) এবং সুবাদার ছিলেন ঔরংজেবের পৌত্র আজিম-উস-শান। করতলব খাঁর বাংলায় দেওয়ান হিসেবে আগমন সুবাদার ভালো মনে গ্রহণ করেননি। কারণ এতদিন তিনি একাই বাংলার ঐশ্বর্য ভোগ করছিলেন। করতলব খাঁ রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করে অপচয় বন্ধ করেন এবং প্রথম বছরেই সম্রাট ঔরংজেবকে এক কোটি টাকা রাজস্ব পাঠান।
অসন্তুষ্ট সুবাদার আজিম-উস-শান এবার ভাড়াটে সৈন্যদলের নেতা আব্দুল ওয়াহিদ-এর সঙ্গে মিলে করতলব খাঁকে রাস্তার মাঝেই হত্যার ষড়যন্ত্র করেন এবং ব্যর্থ হন। করতলব খাঁ জানতেন চক্রান্তের মূল নায়ক সুবাদার স্বয়ং। তিনি সুবাদারকে অবিচলিত ভাবে জানালেন যে, তাঁকে হত্যার চক্রান্তের কথা সম্রাটকে জানানো হবে। শাস্তির ভয়ে সুবাদার ভীত হলেন এবং আব্দুল ওয়াহিদকে ভীষণ তিরস্কার করে অবস্থার সামাল দিলেন। করতলব খাঁ আব্দুল ওয়াহিদকে সঙ্গে নিয়ে নিজ দফতরে এসে, হিসেবপত্র দেখে মিটিয়ে দিলেন ভাড়াটে সৈন্যদের প্রাপ্য এবং বরখাস্ত করলেন সব ভাড়াটে সৈন্যকে। নিজেই সমস্ত ঘটনার বিবরণ লিখে সম্রাটকে জানালেন। সম্রাট সুবাদারকে কড়া ভাষায় জানালেন, বিশ্বাসী করতলব খাঁর কোনওরকম ক্ষতি হলে তিনিও রেহাই পাবেন না।
সম্রাটের আশ্বাস সত্বেও করতলব খাঁ সুবাদারকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি জাহাঙ্গীরনগর থেকে তাঁর কার্যালয় বাংলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মুখসুদাবাদ (বর্তমানে মুর্শিদাবাদ)-এ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ করতলব খাঁ নিজেই ছিলেন মুখসুদাবাদের ফৌজদার। তাছাড়া এই স্থান থেকে গঙ্গার তীরবর্তী কাশিমবাজার, চন্দননগর ও কলকাতায় অবস্থিত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর উপর নজরদারি করাও সুবিধেজনক হবে। এরপর করতলব খাঁ রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করায়, বৃদ্ধি হতে থাকল রাজস্ব। দূরদর্শী দেওয়ান মনস্থির করলেন, নিজে রাজস্ব নিয়ে সম্রাটের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে সাক্ষাৎ করবেন। মুখসুদাবাদ থেকে বহুরকম দুর্লভ উপহার সামগ্রী, নগদ টাকা, কয়েকশো অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে দাক্ষিণাত্যে পৌঁছোলেন।
সম্রাট ও তাঁর মন্ত্রীদের দিলেন অমূল্য সব উপহার। সম্রাট খুশি হয়ে করতলব খাঁ-কে বহু উপহার সহ ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করলেন এবং মুখসুদাবাদকে ‘মুর্শিদাবাদ’ নাম করার অনুমতি দিলেন। করতলব খাঁ দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে মুখসুদাবাদের নতুন নাম দিলেন মুর্শিদাবাদ এবং চালু করলেন নতুন এক টাঁকশাল। শুরু হালে মুর্শিদাবাদের অগ্রগতি।
ক্রমে ব্যবসায়ীরা নির্মাণ করলেন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, আমলা ব্যাংকার-রা তাঁদের কার্যালয় স্থাপন করলেন। ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে আসা রাজকর্মচারী ও বিশিষ্ট মানুষেরা নিজেদের বাসস্থান নির্মাণ শুরু করলেন। মুর্শিদাবাদ এক অনন্য নগরীর রূপ পেতে শুরু করল। ঔরংজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির মসনদে বসেন একে একে আজম শাহ, বাহাদুর শাহ (প্রথম), জাহানদার শাহ এবং ফারুক শিয়র, যিনি ১৭১৬ সালে মুর্শিদকুলি খাঁকে বাংলার সুবাদার ঘোষণা করেন। ফলস্বরূপ ঢাকার পরিবর্তে বাংলার রাজধানী হল মুর্শিদাবাদ এবং সেখানে ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রভূত বিকাশ ঘটল। তখন বাংলার রাজস্বই দিল্লির আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল বলে মুর্শিদকুলি খাঁ হয়ে উঠলেন বাংলার সর্বেসর্বা। তাই বলা হয়, বাংলায় স্বাধীন নবাবির প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকুলি খাঁ।