ইতিহাস থেকে আবার বর্তমানে ফিরি। কাটরা মসজিদে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে উঠে বসি অটোয়। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কাঠগোলা বাগান। বহুরকম গাছপালায় ভরা প্রায় সীমাহীন বাগানের মাঝে অবস্থিত কয়েকটি প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল, মুখ্যত নবাবের ইউরোপিয়ান ও মুসলিম অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য। প্রাসাদ তৈরির আগে এই অঞ্চলে ছিল কাঠের গোলা বা ভাণ্ডার, তাই জায়গাটির নাম কাঠগোলা। মাথাপিছু ৩০ টাকা প্রবেশমূল্য কেটে ঢুকতে হল বাগানে। প্রাসাদের সুড়ঙ্গপথ, নাচমহল এবং কয়েকটি অসাধারণ অয়েল পেন্টিং-এর সমাহার অবাক করে দিল আমাদের। আরও কিছুটা এগিয়ে একটি জৈন মন্দির, সেখানে আদিনাথ (মতান্তরে পরেশনাথ)-এর সুন্দর একটি পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া এখানে একটি চিড়িয়াখানা রয়েছে, যেটা আমরা না দেখে অটোতে চেপে এগিয়ে চললাম জগৎ শেঠ-এর বাড়ির উদ্দেশে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নসিপুর এলাকায় অবস্থিত জগৎ শেঠ-এর সুদৃশ্য বাড়ির কাছে এসে পৌঁছোলাম। একে প্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না, যা আজ এক মিউজিয়ামে পরিণত। এখানে মাথা পিছু ২০ টাকার টিকিট কিনে একজন গাইড নিলাম মাত্র ৫০ টাকায়। অল্পবয়সি গাইড আমাদের সঙ্গে নিয়ে জগৎ শেঠ বংশের বাড়ি তথা মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল। নবাবশাসিত তৎকালীন বাংলার ছবি ক্রমশ দৃশ্যমান হতে লাগল মিউজিয়ামে রক্ষিত বিভিন্ন জিনিসপত্রের মাধ্যমে। বুঝতে পারলাম, ইতিহাস আবার আমাকে কাছে ডাকছে।
মিউজিয়ামে দাঁড়িয়ে প্রথমেই পাঠকদের জানাতে চাই যে, জগৎ শেঠ কোনও এক ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়, বরং নবাবি বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের এক ধনী, ব্যবসায়ী পরিবার তথা বংশের নাম। ‘জগৎ শেঠ' শব্দ দুটির অর্থ ‘জগতের ব্যবসায়ী তথা মহাজন'। ইতিহাস জানায় ওই বিশেষ বাড়িটির প্রতিষ্ঠাতা হিরানন্দ শাহ, যিনি রাজস্থানের নাগর থেকে পাটনায় আসেন ১৬৫২ সালে। তাঁর উত্তরসূরি মানিক চাঁদ ১৭০৭ সালে প্রিন্স ফারুকশিয়ারকে আর্থিক দানের মাধ্যমে মুঘল সম্রাট হতে সাহায্য করেন। প্রতিদানে সম্রাট ফারুকশিয়ার ওই পরিবারের প্রধান মানিক চাঁদকে ‘জগৎ শেঠ' উপাধি প্রদান করেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার সরকারি ঐতিহাসিক রোবেন ওরমে জগৎ শেঠকে তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী তথা মহাজন হিসেবে বর্ণনা করেন। জগৎ শেঠ পরিবার সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড়ো ব্যাংকিং হাউস ছিল। ১৭৫০ সালে তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ কোটি টাকা।