দেখতে দেখতে ক”টাদিন পার হয়ে গেল। এখানে আসার আগে রমেন্দু মনে মনে ধরেই নিয়েছিলেন তিনি এই শহরের একজন বিস্মৃত মানুষ। হয়তো সবাই তাঁকে ভুলেই গিয়েছে। কিন্তু এখানে আসার পর সেই ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেল। আশ্চর্য! এখনও বহু মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে। এমনকী তাঁর ছেলেদের কৃতিত্বের কাহিনি পরবর্তী প্রজন্মের কচিকাঁচাদের উদাহরণ হিসেবে শোনানো হয়।

কথায় কথায় শিবতোষ বললেন, ‘তুই হলি গিয়ে গর্বিত পিতা। তোর দু’ছেলে যাকে বলে জুয়েল। ওরা দুইভাই যেসময় বোর্ডের পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে দেখিয়েছিল, সেটা নিঃসন্দেহে বিরল নজির। তোদের কথা এই ছোটো শহরের মানুষ কী করে ভুলবে বল? ওদের জন্য কত সন্মান এসেছিল এখানে। তোরা ভুলে গেলেও, তোদের কথা আমরা ভুলতে পারব না।’

শিবতোষের শেষটা মর্মে বিধল রমেন্দুর। এই পথ দিয়েই একদিন গন্তব্যের দিকে গিয়েছিলেন, সেই পথটাকে আজ ভুলে বসে আছেন! মাথা নত করে রইলেন বেশ কিছুটা সময়।

শিবতোষের ছোটো বউমা রিনিকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন রমেন্দু। রিনি বেশ উচ্ছ্বল, টুকির চেয়ে চালাকচতুরও বটে। বুনিয়াদপুর তার স্মৃতির কায়া পালটেছে, অঙ্গসজ্জা বেড়েছে অনেক। এখন মিউনিসিপ্যালিটি। বড়ো বড়ো দোকান গজিয়েছে। বিশ্বায়নের ধাক্কায় শপিং মল তৈরি হয়েছে দু’দুটো। তিনি যখন ছেড়ে যান তখন ‘মা কালী বস্ত্রালয়’ ছাড়া আর কোনও কাপড়ের দোকান ছিল না। ভালো কিছু কিনতে হলে যেতে হতো সদরে।

নতুন শপিং মল ‘ড্রেসিং বাজার’-এ ঢুকলেন রমেন্দু। সঙ্গে রিনি। শপিং জিনিসটা কোনও দিনই পছন্দের ছিল না রমেন্দুর। ওসব লতাই সামলেছে। মেয়েদের একটা সহজাত দক্ষতা থাকে ওই বিষয়ে৷ শপিং করতে পছন্দ করে না এমন মেয়ের সংখ্যা খুব কম। তবে রিনি বেশ পটু। রমেন্দু শুধু সাজেশন দিলেন, রিনি বেছে বেছে কিনে ফেলল সেসব। সব শেষে টাকার অঙ্কটা দেখে রিনি বলল— “আমাদের জন্য এত দামি দামি জিনিস কেনার কী দরকার ছিল কাকাবাবু?”

কার্ডে পেমেন্ট করে রমেন্দু বললেন, ‘টাকা আসবে যাবে আমি আর আসতে পারব কিনা কোনও গ্যারান্টি আছে? তোমাদের এটুকু দিতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে। ওসব কথা ছাড়ো, তোমার জন্য যে-শাড়িটা নিয়েছি সেটা একবার পরে দেখিও কিন্তু। আমি ছবি তুলে রাখব।’

রিনির চোখ দুটো আনন্দে ঝকঝক করে উঠল, “আমি আজকেই পরে দেখাব।”

সবার জন্যেই কিছু না কিছু নিয়েছেন রমেন্দু। ভাইয়েরা এটাকে লোক দেখানো প্রদর্শন মনে করলেও কিছু মনে করেননি। ওরা এখনও ভাবে, সাফল্যটা দাদার যেন বাঁধা লক্ষ্মী। এখনও সেই ভয়ংকর ঈর্ষা বয়ে চলেছে! ঈর্ষার জায়গায় যদি একটু অন্য ভাবে দেখত? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আপন মনেই স্বগতোক্তি করেন রমেন্দু — সাফল্য আর জয় এক জিনিস নয়। অথচ এরা সেটাকেই অমোঘ সত্য ধরে জীবনটাকে…।

আজ রাতে শিবতোষের বাড়িতে নেমন্তন্ন। এই নিয়ে দু’তিন দিন তো হয়েই গেল। আজকেরটা স্পেশাল কারণ কাল সকালের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাচ্ছেন রমেন্দু। মেয়েরা ভেতরে রান্নায় ব্যস্ত। বাইরের বারান্দায় ছেলেরা মাদুর বিছিয়ে গোল হয়ে বসেছে। চা আর মুড়ি সহযোগে আড্ডা জমে উঠেছে।

শিবতোষ বললেন, “একবার সময় করে ওদের সবাইকে নিয়ে আয়। খুব ভালো লাগবে।’

শিবতোষের বড়ো ছেলে শেখর বলল, ‘হ্যাঁ কাকাবাবু। রিটায়ার করেছেন আর তো কোনও টান নেই।”

রমেন্দু বললেন, “ওদের কথা বলতে পারি না, তবে আমি আসব। লতাকেও আনার চেষ্টা করব। আসলে, না আসতে আসতে এমন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই আসা তো কিছুটা জোর করেই। কী মনে হল ভাবলাম জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একবার জন্মভিটেটা দেখেই আসি। তাছাড়া এখন আমার হাতে অফুরন্ত সময়। ছেলেরা বিদেশে, শেষ কবে সবাই একসঙ্গে হয়েছি বলা মুশকিল। বাড়িতে তো দুটো প্রাণী, আমি আর লতা। লতা ওর ভাইয়ের বাড়ি গেল ধানবাদ, আমি ভাবলাম এই সুযোগে…

শিবতোষ বললেন— আমি যে কী খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারব না। তোর ছেলেরাও এখানেই জন্মেছে, তবুও ওদের ফিলিংস একটু অন্যরকম হবেই। তাছাড়া পড়ুয়া ছেলেদের মাঠঘাট, বনবাদাড়ের স্মৃতি কম থাকে। ওদের লক্ষ্য সব সময় উঁচুতে ছিল। ক’জন আর ওরকম হতে পারে? কিন্তু তুই তো বনেবাদাড়ে ঘোরা ছেলে, তোর আমাদের সেইসব দিনের স্মৃতি মনে পড়ত না? অবশ্য ওদের পিছনে তোকে তো কম সময় দিতে হয়নি। সেদিক থেকে তুই সফল।

ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রিনি। ডানহাতে জলের গেলাস বাঁ হাতে ওষুধ। শিবতোষের দিকে এগিয়ে ধরে বলল, “বাবা তোমার প্রেশারের ওষুধ। দিদি পাঠিয়ে দিল। ঝটপট খেয়ে নাও।’

বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে নিল শিবতোষ। রিনি এবার রমেন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল— দিদি বলল, আর একবার চা দেব কাকাবাবু? রান্না কমপ্লিট হতে কিছুটা সময় লাগবে।

—দেবে, তবে দাও। চা-তে আমার আপত্তি থাকে না, জেনে ফেলেছ দেখছি!

রিনি মিষ্টি হেসে চলে যাচ্ছিল, পিছু ডাকল শেখর— বাবার প্রেশারের ওষুধ আর ক’টা আছে টুকিকে একটু দেখে রাখতে বোলো তো রিনি, কাল সকালে এনে রাখব তাহলে।

রিনি মাথা নেড়ে চলে যেতেই শেখর রাজার দিকে তাকিয়ে বলল- মায়ের চশমাটা ঠিক করতে দিয়েছিলি, ওটা এনেছিস রাজা ?

রাজা বলল— গিয়েছিলাম। কিন্তু বিল্টুদা বলল, মায়ের পাওয়ার সম্ভবত বেড়েছে। কলকাতার ডাক্তার আসবে পরশু, তাকে একবার দেখিয়ে নিতে বলল। আমিও ভাবলাম সেটাই ভালো হবে। নাম লিখিয়ে দিয়েছি, পরশু রিনি দেখিয়ে আনুক মাকে। তারপরেই না হয় চশমা বানানো যাবে।

কবজি ডুবিয়ে খেলেন রমেন্দু। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত চলল গল্প গুজব আর আড্ডা। জমাটি আড্ডা ছেড়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না রমেন্দুর। কলকাতায় ফিরে আবার তো সেই একঘেয়ে জীবন। অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো বুড়ির উপাখ্যান। প্রতিদিনের ছাঁচে ঢালা রুটিন। মর্নিং ওয়াক, বাজার, খবরের কাগজ, টিভি, মোবাইল – একটা যান্ত্রিক বৃত্ত!

শিবতোষই স্মরণ করিয়ে দিলেন- অনেক রাত হল রে, এবার শুয়ে পড়গে যা। তোকে আবার ভোরের ট্রেন ধরতে হবে।

হঠাৎ রমেন্দুর চোখ ছলছল করে উঠল। শিবতোষ অবাক হয়ে বললেন— কী হল রে?

রমেন্দুর গলা ভার। ‘আমার সব গর্ব চুরমার হয়ে গেছে রে শিবু! বহুকাল একটা অহংকার মনে বাসা বেঁধে ছিল। মনে মনে ভাবতাম, আমি সত্যি সত্যি এক গর্বিত পিতা। আমার সমকক্ষ হতে পারা সহজ কাজ নয়। এখন মনে হয় ওটা আমার পরাজয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার বড়ো হওয়া সন্তানেরা হয়তো অনেক বড়ো বড়ো কাজ করবে কিন্তু কোনও দিন এসে মাকে বলবে না, চলো মা তোমাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি। পুত্রবধূরা কোনও দিন বলবে না, বাবা এই নিন আপনার প্রেশারের ওষুধ। এ বড়ো যে অনেক বড়ো রে শিবু, ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

শিবতোষ অবাক হয়ে দেখলেন, রমেন্দুর মুখে চোখে সেই ঝলমলে দীপ্তি আর নেই। সেই জায়গায় শেষ বিকেলের অসীম শূন্যতা। কোনও উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলেন না শিবতোষ ।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...