এইসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম মুর্শিদাবাদের সবশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হাজারদুয়ারি প্যালেসের কাছে। মেন গেট দিয়ে ঢুকে টিকিট ঘরের দিকে এগোতেই একজন যুবক আমাদের কাছে এগিয়ে এল। নিজের নাম বলল রনি এবং পরিচয়পত্র দেখিয়ে জানাল, প্যালেসের অন্যতম রেজিস্টার্ড গাইড সে। মাথাপিছু টিকিট মূল্য ২০ টাকা এবং তার ফি ১৫০ টাকা প্রতি ঘণ্টার জন্য। তবে পর্যটকদের সঙ্গে প্যালেসের ভিতরে ঢোকার অনুমতি তার নেই। তাই প্যালেসের বাইরে দাঁড়িয়েই প্রথমে সে হাজারদুয়ারি প্যালেস চত্বরে অবস্থিত প্রতিটি দ্রষ্টব্য (নিজামত ইমামবাড়া, ওয়াসেফ মঞ্জিল, সিরাজদৌল্লার মদিনা, ঘড়ি মিনার এবং বাচ্চাওয়ালি তাপে ) তথা ইমারতের ইতিহাস জানাল। তারপর সে ব্যাখ্যা করল, প্যালেসের ভিতরে কীভাবে ঘুরে ঘুরে সম্পূর্ণ মিউজিয়ামটিকে দেখতে হবে। এইবার সে আমাদের দেখাল প্যালেসের কয়েকটি আসল ও নকল দরজা। হাজারদুয়ারি প্যালেসে প্রকৃতপক্ষে ৯০০টি আসল দরজা, বাকি দরজাগুলি অবিকল নকল। এরপর সে আমাদের নিয়ে প্যালেসে ঢোকার লাইনে দাঁড় করিয়ে বিদায় নিল। আমরা কয়েক মিনিট পরেই ঢুকে পড়লাম প্যালেসের দরবার হলে।
এক ঘণ্টা ধরে তিনতলা প্যালেসের (বর্তমানে মিউজিয়াম) বিভিন্ন কক্ষে ও বারান্দায় রক্ষিত অস্ত্রসম্ভার, নবাবদের প্রায় নিখুঁত প্রতিকৃতি (পোর্ট্রেট), অসাধারণ কিছু ছবি, হাতির দাঁতের তৈরি অতি সুন্দর জিনিসপত্র, নানারকমের পাল্কির সংগ্রহ এবং বিশাল ঝাড়বাতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মীরজাফর-এর বংশধর নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহ-এর জন্য ১৮৩৭ সালে হাজারদুয়ারি প্যালেস তৈরি হয় বিখ্যাত স্থপতি ডানকান ম্যাকলিয়ড দ্বারা। অসাধারণ এই প্যালেসে রয়েছে ১১৪টি ঘর এবং ৮টি গ্যালারি।
প্যালসের বাইরে এসে একটু হেঁটে পৌঁছোলাম ছোটো মসজিদ মদিনা-র কাছে। হজরত মহম্মদের মদিনা মসজিদের অনুকরণে তৈরি প্রকৃত মসজিদের ভিতে ছিল মক্কা থেকে নিয়ে আসা মাটি। সেই মসজিদ আগুনে ধ্বংস হয়ে গেলে পরবর্তী (বর্তমান) মসজিদের ভিতে রয়েছে কারবালার পবিত্র মাটি। মসজিদ বন্ধ ছিল। জানলাম, মসজিদের ঘরগুলি একসঙ্গে ৭০০ জন কোরান পাঠ করতে পারে। মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ ফুট উঁচু মিনার দুটি আজও বিদ্যমান। এবার আমরা এগোলাম নিজামত ইমামবাড়ার দিকে যার অবস্থান হাজারদুয়ারি প্যালেসের উত্তর মুখের সমান্তরালে।
১৮৪৭ সালে নবাব নাজিম মনসুর আলি খাঁ ফারাদুন জাহ্ দ্বারা নির্মিত এই সৌধ বাংলার বৃহত্তম ইমামবাড়া। তারপর আমরা প্যালেসের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ওয়াসিফ মঞ্জিলে গিয়ে পৌঁছোলাম। হাজারদুয়ারি প্যালেস তৈরির অনেক পরে এই ছোটো কিন্তু সুন্দর প্যালেসটি নির্মিত হয় নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা খান দ্বারা। অনেকে তাই এটাকে ‘নতুন প্যালেস’ বলে।
হাজারদুয়ারি প্যালেস দেখে অটোয় করে চললাম মোতিঝিল। ১০-১২ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম। একসময় সেখানে ছিল সুন্দর এক প্রাসাদ ও লেক। প্রাসাদ বিনষ্ট হয়েছে আগেই আজ শুধু লেক বিদ্যমান। সেই লেককে ঘিরেই বিরাট পার্ক এবং বিনোদনের যাবতীয় ব্যবস্থা। এখানে ইতিহাস অন্তর্হিত, শুধুই সজীব বর্তমান। দেখা শেষ করে ফিরে এলাম হোটেলে।
লাঞ্চ সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে স্টেশনে এলাম। আমাদের ট্রেন কয়েক মিনিট লেটে স্টেশনে এসে পৌঁছোল। ফিরে চলা কলকাতার উদ্দেশে। মন পড়ে রইল মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের মাঝে।
কীভাবে যাবেন: কলকাতা ও শিয়ালদা থেকে সারাদিনে বেশ কয়েকটি ট্রেন যাচ্ছে লালবাগ। মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেলে নামতে হবে বহরমপুর কোর্ট বা পরের স্টেশন মুর্শিদাবাদে। দূরত্ব ১৯৩ কিমি, সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘন্টা। কলকাতা থেকে সড়কপথে বাস বা নিজের গাড়িতেও আসতে পারেন। দূরত্ব ২৩০ কিমি, সময় লাগবে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা।
কোথায় থাকবেন: বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদে থাকার জন্য বিভিন্ন বাজেট-এর অনেক হোটেল আছে।
কখন যাবেন: বছরের যে-কোনও সময় মুর্শিদাবাদে বেড়াতে আসা যায়। তবে, শীতকাল হল ভ্রমণের আদর্শ সময়।