মঞ্চে এবং রুপোলি পর্দায় প্রতিভার আলো ছড়িয়েছেন তিনি। প্রায় কুড়ি বছর ধরে নির্দেশক হিসাবে কাজ করে চলেছেন সুমন মুখোপাধ্যায়। বাংলা ছবি ছাড়াও, সিনেমাপ্রেমীদের নজর কেড়েছে সুমনের হিন্দি ছবি ‘নজরবন্দ’। তাঁর প্রতিটি নাটক এবং ছবির বিষয়বস্তুতে থাকে সমাজ থেকে রাজনীতি সব-ই। কখনও হালকা চালে, কখনও আবার গুরুগম্ভীর ভাবে নানারকম সমস্যাকে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর ছবি এবং নাটকে। নির্দেশক সুমন মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেন অকপটে।
অনেকরকম বিষয় নিয়ে আপনি ছবি তৈরি করেছেন। কীভাবে কিংবা কী ভেবে বিষয় নির্বাচন করেন?
সবকিছু নির্ভর করে সময় এবং পরিস্থিতির উপর। যখন যে বিষয়টা প্রাসঙ্গিক মনে হয় এবং আমার মাথার মধ্যে চেপে বসে, তখন সেই বিষয় নিয়ে ছবি তৈরি করি। তবে যে-বিষয় নিয়েই ছবি তৈরি করি না কেন, আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও খুব নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম করেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কাজ করি। আর এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলতে চাই, আমার প্রায় সব ছবিতেই কিছু সামাজিক বার্তা থাকে। শুধু তাই নয়, দর্শকদের পছন্দের বিষয়টি মাথায় রেখেও ছবি বানাই আমি।
সমকালীন নাকি কালজয়ী, কোন বিষয় প্রভাবিত করে ছবির বিষয় নির্বাচণের ক্ষেত্রে?
দেখুন, প্রথমে আমার যে-বিষয়টা ভালো লাগে, সেই বিষয় নিয়ে আমি ছবি তৈরি করি। এরপর দর্শকরা দেখে বিচার করবেন, সেই বিষয়টি সমকালীন নাকি কালজয়ী। তবে আমার ছবি হারবার্ট, চতুরঙ্গ, মহানগর@কলকাতা, শেষের কবিতা কিংবা অসমাপ্ত-র বিষয় তাৎক্ষণিক নয় নিশ্চয়ই। তবে আমি মনে করি, বিষয় যাই হোক না কেন, দর্শকদের ভালোলাগা দরকার। তাদের মনে গেঁথে গেলে ছবি সাফল্য পাবেই। তাই আমার মাথার মধ্যে যে প্রশ্নটা তৈরি হয় প্রথমে, তা হল— যে-বিষয়টা নিয়ে ছবি তৈরি করতে যাচ্ছি, তা দর্শকদের মন জয় করবে তো? কারণ আমি মনে করি, মানুষের মন-ই হল সবচেয়ে বড়ো ক্যানভাস। আর সেই মনের ক্যানভাসে ভালো ভাবে ছবি আঁকতে পারলেই তা কালজয়ী হয়ে উঠবে।
আপনার সাম্প্রতিক ছবি ‘নজরবন্দ‘ কলকাতা আন্তর্জাতিক উৎসবে দর্শকচিত্ত জয় করেছে। ছবিটি আর কোথায়, কী সাফল্য পেয়েছে?
বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ছাড়াও, লন্ডন, নিউইয়র্ক, মিউনিখ, বার্সেলোনা প্রভৃতি দেশের চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রশংসিত হয়েছে। ফ্লোরেন্স-এর রিভার টু রিভার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ পেয়েছে অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড। আমার সব ছবিই কমবেশি সাফল্য পেয়েছে, তবে ‘নজরবন্দ’ দর্শকদের ভালো লেগেছে দেখে আমি ভীষণ আনন্দিত। কারণ, ছবিটি আমি হিন্দিতে বানিয়েছি। আর ভালোবাসার কিংবা বলতে পারেন মানবিক সম্পর্কের বিষয় সমৃদ্ধ এই ছবিটি দর্শকদের মনে অনেকদিন গেঁথে থাকবে বলেই আমার মনে হয়।
আর কী ধরনের বিষয় নিয়ে ছবি তৈরি করার ইচ্ছে আছে আপনার?
আমি আগে থেকে তেমন কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখিনি। সময় এবং পরিস্থিতির উপর সবটাই নির্ভর করবে। তবে এটা ঠিক, যে বিষয় আমার মনকে নাড়া দেবে, সেই বিষয় নিয়ে আমি ছবি তৈরি করব। আর সমাজের ভালোমন্দ দিকগুলিকে বারবার ছবিতে তুলে ধরতে ইচ্ছে করে আমার।
আপনার বাবা–র থিয়েটার গ্রুপ ছিল, আপনিও থিয়েটার দিয়ে শুরু করেছেন এবং সমৃদ্ধ করেছেন এই জগৎকে। বর্তমানে বাংলা থিয়েটার–এর বিষয়ে কী বক্তব্য আপনার?
পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটারপ্রেমী মানুষদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। আমরা দর্শকদের ভালোবাসায় ধন্য। তবে করোনা মহামারির কারণে অনেকদিন আমরা দর্শকদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। ধীরে ধীরে সবই আবার চেনা ছন্দে ফিরছে। এখন সবাই তাই খুশি। করোনা-র আগে যেমন বিভিন্ন জায়গায় শো করে আনন্দ পেতাম, আবারও সেই ছন্দে ফিরছি আমরা। তাই খুবই ভালো লাগছে। পশ্চিমবঙ্গে অনেক থিয়েটার গ্রুপ আছে এবং এই পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেকের মুখে হাসি ফুটছে আবার, বিষয়টি তাই তৃপ্তিদায়ক। তবে ৭০ কিংবা ৮০-র দশকে থিয়েটার-এর হালচাল একরকম ছিল, এখন নানা কারণে অনেকটাই বদলেছে। অবশ্য তখন ভালো ছিল নাকি এখন ভালো হয়েছে, এই বিষয়ে না যাওয়াই ভালো। কারণ, ভালোমন্দের বিষয়টি ব্যক্তিনির্ভর।
আপনি কি মনে করেন যে, সরকার পরিবর্তনে শিল্প–সংস্কৃতির উপর প্রভাব পড়ে?
প্রভাব যে পড়ে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজ-সংসারের মতো শিল্প-সংস্কৃতির জগতেও রাজনীতির প্রভাব পড়ে। কারণ, যে-দর্শকদের ভালোবাসা না পেলে শিল্প-সংস্কৃতি বাঁচবে না, সেই দর্শকদের জীবনধারা রাজনীতির দ্বারা প্রত্যক্ষে কিংবা পরোক্ষে প্রভাবিত। দর্শকরা মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক ভাবে ভালো থাকলে প্রেক্ষাগৃহে এসে সিনেমা কিংবা থিয়েটার দেখবেন। আর দর্শক সমাগম হলে তবেই সিনেমা কিংবা থিয়েটার বাঁচবে। তাছাড়া, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও সিনেমা-থিয়েটার-এর বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, যে-কোনও সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা কিংবা আন্দোলনে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের লোকেরাও শামিল হন। পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মতো বহু ক্ষেত্রে শামিল হয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা। তবে এটা ঠিক যে, সময়-সুযোগের অভাবে সব আন্দোলনে হয়তো সবাই যোগ দিতে পারেন না।
অনেক নাটকে যেমন তুলে ধরা হয়েছে স্ট্রিট পলিটিক্স, ঠিক তেমনই আরও অনেক সিরিয়াস টপিক ও প্রাধান্য পেয়েছে বহু নাটকে। আমরা অনেকে উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র প্রমুখের পথ অনুসরণও করেছি নাটকের বিষয়বস্তুতে। সবমিলে বলা যায়, নাটকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব আগেও ছিল, এখনও আছে।
অনেক অভিনেতা–অভিনেত্রী, নির্দেশককে এখন রাজনীতিতে বেশি মনোনিবেশ করতে দেখা যাচ্ছে। কী বলবেন এই প্রসঙ্গে?
আপনি ঠিকই বলেছেন। শিল্প-সংস্কৃতির জগতের যারা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা রাজনীতি নিয়ে যতটা মেতে থাকেন, ততটা আর তাঁদের নিজের মূল পেশায় মনোনিবেশ করতে দেখা যায় না। কিন্তু আমার মতে, সত্যিই যাঁরা শিল্প সংস্কৃতির জগতের মানুষ, তাঁদের সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যাওয়া উচিত নয়। কারণ, পলিটিক্যাল পার্টির ফুল টাইমার হলে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের কাজে আর মনোনিবেশ করা যায় না ঠিক মতো। শুধু তাই নয়, কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে, অন্য দলের সমর্থকরা আর সেই শিল্পীকে সুনজরে দেখেন না, এটাই বাস্তব। অর্থাৎ, শিল্পীরা রাজনীতিতে যোগ দিলে, তাঁর সাংস্কৃতিক গুণমুগ্ধের সংখ্যা কমবেই।
সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট এখন কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন আপনি?
দেখুন, যে-কোনও বড়ো আন্দোলনে সাধারণ মানুষ থেকে বুদ্ধিজীবী সকলেই শামিল হয়ে যান, এটাই বাস্তব। এর জন্য আলাদা করে কোনও প্রতিভা লাগে না। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন যে, সিএএ, এনআরসি কিংবা অন্য অনেক জাতীয় স্তরের আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ শামিল হয়েছেন বহুবার। এখন যেমন যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলনকেও অনেকে নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছেন। তবে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট-এর দিকে যদি লক্ষ্য রাখেন তাহলে দেখবেন, সব আন্দোলন সাফল্য পায় না সবসময়। কারণ, ব্যক্তিজীবন এবং সামাজিক জীবনের নানারকম জটিলতার কারণে সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন আন্দোলনে শামিল হতে পারেন না। তবুও বলব, সিভিল সোসাইটি আন্দোলন জিইয়ে রাখা দরকার সাধারণ মানুষের স্বার্থে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন বলে মনে হয় আপনার?
বাংলার মানুষ রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। প্রত্যেক নাগরিক জানেন কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। এখানে এখনও পোশাক থেকে ভাষা সবই গুরুত্ব পায়। এক আলাদা ছন্দ আছে বাংলার মানুষের মধ্যে। হঠাৎ করে কেউ এসে এখানে জমি তৈরি করতে পারবে না বলেই আমার মনে হয়।
জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে কী বক্তব্য আপনার?
অনেক ঘটনাই তো ঘটেছে বা ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক কারণে অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণও গেছে। সে যে দল-ই হোক না কেন, কোনও সংকীর্ণ রাজনীতি সমর্থনযোগ্য নয়। আমার তো মনে হয়, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মাত্রেই চান যে, রাজনৈতিক কারণে নিরপরাধ মানুষের প্রাণ যেন না যায়। রাজনৈতিক বিশ্বাস কিংবা সমর্থন থাক মনে মনে। কোনও কিছু যেন জনবিরোধী না হয় এবং ক্ষতিকারক না হয়— এটাই কাম্য।
এই প্রসঙ্গে আর যে-বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হল, বাক-স্বাধীনতা। কোনও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে স্বাধীন ভাবে কথা বলার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত নয় এবং যদি কেউ কেড়ে নিতে আসে, তাহলে সমস্বরে প্রতিবাদ করা দরকার। ব্যক্তি কিংবা সমষ্টিগত ভাবে কোনও কিছুর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানালে তাদের বেআইনি ভাবে শাস্তি দেওয়াকে সমর্থন করা যায় না।