বিকেল চারটে নাগাদ গেলাম প্রথমে কেলভার শীতলাদেবী মন্দির। পুজোর নৈবেদ্য-ডালির কিছু দোকান, শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরটির রানি অহল্যাবাঈ হোলকরের তত্ত্বাবধানে প্রভূত সংস্কার হয়। স্থানীয় কথন-এক কৃষক দেবীমাতার স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মাটি খনন করে পাথরের এক দেবীমূর্তি পান। যে-স্থানে খনন করা হয়েছিল সেইখানেই প্রতিষ্ঠিত করা হয় মন্দির।
১৯৮৬ সালে মহারাষ্ট্র সরকার মন্দিরটির পুনঃসংস্কার করে। মার্বেলখোদিত মন্দিরের গর্ভগৃহে রুপোর চূড়ামুকুট, সবুজ-কমলাজরির শাড়ি পরিহিতা একখণ্ড পাথরের মূর্তি। মূর্তির অবয়বে শান্তশ্রী রূপটান। সামনে দানপেটিকা। একই চত্বরে শ্রীহনুমান মন্দির ও রামকুণ্ড নামে বাঁধানো জলাশয় রয়েছে। মন্দিরদ্বয়ের মাথায় কমলা নিশান সাগরের লোনা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে।
সাগরসৈকতের কিছুটা উঁচুতে ঝাউ বনবীথির পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। সেখানে সাগরের দিকে মুখ করে অঢেল বসার ব্যবস্থা। সুরুবন তথা ঝাউবনে ভাড়া করা প্লাস্টিকের মাদুর বিছিয়ে বিভিন্ন দলবদ্ধ হয়ে আড্ডায় মেতেছেন অনেক পরিবার। কেউ বসে, কেউ দু’পা ছড়িয়ে, কেউ আধ শোয়া হয়ে। এখানে প্রায় প্রতিটি দোকানেই অন্যান্য বিক্রয়লব্ধ সামগ্রীর সঙ্গে ঘন্টা প্রতি ভাড়া দেওয়ার জন্য প্লাস্টিকের মাদুরের ব্যবস্থা রয়েছে। সিমেন্ট বাঁধানো ছাউনির তলায় বেলা বয়ে যায় চূড়ান্ত আলস্যে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সূর্য পাটে নামার ক্ষণ আসে। সেই চিরন্তন ক্ষণে হেমন্তের আকাশ জুড়ে ম্যাজিক শুরু হয়ে যায়।
রোদ্দুর সামান্য ফিকে হতে গড়ানে বালুপথে সৈকতে নেমে আসি। সাগরজল তখন যদিও আর নাগালে নেই। আরবসাগর তখন বিশ্রাম নিচ্ছে একেবারে দিগন্তের গায়ে ঠেস দিয়ে। ভাটার টানে সাগর এতটাই সরে যায় যে, অনায়াসে পরপর তিন-চারটে ফুটবল ম্যাচ খেলার জায়গা হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সূর্যগোলক আকাশে গোলাপি-কমলা আভা ছড়াতে ছড়াতে হেলে পড়তে শুরু করেছে। ভেজা বালির বুকে তার দীর্ঘ বিচ্ছুরণ। পর্যটকদের মোবাইল ক্যামেরা এন্তার ঝলসে উঠছে সেই সূর্য ডোবার পালাকে ধরে রাখার জন্য।
পরদিন সকালে গাড়ি বুক করে চলে এলাম Kelva দুর্গের গর্বিত ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে। সাগরের জলশরীরের মাঝে দুর্গটির উপস্থিতি কোনও সমীকরণ বদলাতে পারে না। অনেকটা বেহালা সদৃশ্য কেল্লাটির আকার। ষোলোশো শতকে কেলভা সৈকতের দক্ষিণে সাগরজলের অভ্যন্তরে দুর্গটি নির্মিত হয় মূলত পর্তুগিজ জলদস্যুদের অতর্কিত হামলা প্রতিহত করতে। মরাঠারাজ ছত্রপতি শিবাজী এখান থেকেও শাসন করতেন।
সাগরপৃষ্ঠ থেকে মাত্রই ৮ ফুট উঁচুতে এই দুর্গে ভরা জোয়ারের সময় সহজে নৌকায় পৌঁছে গেলেও, ভাটার সময় ওই উচ্চতাটুকু পার হতে হয় পদব্রজেই। কেল্লাটির আশ্চর্য গঠন, কারিগরি স্থাপত্য, খিলানযুক্ত প্রবেশপথ ও প্রকোষ্ঠ, পাথুরে সোপানগুলি নির্ঘাত প্ররোচিত করবে কেল্লার ওপরমহলে সার দিয়ে গড়া সশস্ত্র প্রহরীদের বুরুজগুলির কাছে যেতে। দুর্গের অলিন্দে বাতায়নে ইতিহাসের বোবা সাক্ষ্য। এখানে কোনও রহস্যগল্পের শুটিং হতে পারে দিব্য। স্থানীয় অনেকেই একে ‘কেলভা প্যানকট’ বলে থাকেন।
কেল্লার ভেতর এত নরম আলো, এত নরম লোনা হাওয়া, হৈমন্তী সকালে আবছা দেখায় অভ্যন্তর। যদিও সূর্যের আলো ঝিলমিল করছে কেল্লার বাইরে আরবসাগরের জলে। আনমনা হয়ে ভাবি দুর্গের মতো একাকীত্বের যন্ত্রণা যেন আর কোথাও নেই। তারও তো কাঁহাতক আর আদিগন্ত সাগর, পাথর আর কদাচ এই চত্বরে আসা পর্যটকদের পায়ের ধুলোর সঙ্গ যাপনে খুশি থাকা যায়! দিকচক্রবাল জুড়ে সাগরের স্পর্ধা দেখে যাই। এও এক বাহানা।
কীভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে রেলপথ বা উড়ানপথে মুম্বই। সেখান থেকে ওলা বা ক্যাব ভাড়া করে ১১০ কিলোমিটার দূরত্বে Kelva পৌঁছোতে সময় লাগে কমবেশি আড়াই ঘন্টা। শহরতলির ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস রেলপথে কেলভা রোড স্টেশনে নেমে, আট আসনের ‘টুকটুক’ নামের ডিজেলচালিত বড়ো আকারের অটোতে Kelva সৈকতগ্রামে পৌঁছোনো যায়।
কোথায় থাকবেন: অনেক রিট্রিট, হোটেল, ফার্মহাউস রয়েছে। নির্ভেজাল মহারাষ্ট্রিয়ান খাবারের স্বাদ নেওয়া যেতে পারে। কখন যাবেন: বছরের যে-কোনও সময়ই যাওয়া যেতে পারে।