পুরোনো কথা শোনার আগ্রহ স্যমন্তকের তেমন ছিল না। অস্থিরতা বাড়ছিল। সাড়ে চারটের বাসটা না ধরতে পারলে কেস খেতে হবে। তাই ব্যস্ত হয়ে বলল, “এবার আমায় উঠতে হবে ছোটোমা। সাড়ে চারটেতে লাস্ট বাস।’

—হ্যাঁ, তাই তো। গল্পে গল্পে সময়ের খেয়াল ছিল না। তোমাকে এ্যদ্দিন বাদে দেখে সমস্ত পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। তুমি আর একটু বসো, কেমন। তন্দ্রা একবারটি ভেতরে আয় তো।

যাবার আগে স্যমন্তকের মাথায় হাত রেখে মধুরিমা আরও একবার উচ্চারণ করলেন ওম শান্তি। স্যমন্তকও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল তার ছোটোমাকে। তন্দ্রা মধুরিমাকে অনুসরণ করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর আবার ফিরেও এল কয়েক মিনিটের মধ্যে। হাতে একটা সাদা খাম।

—চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিই।

কথাটা বলেই চলে গেল দরজার দিকে। পায়ে গলিয়ে নিল চামড়ার জুতো। তারপর স্যমন্তককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে। কয়েক মিনিট চুপচাপ হাঁটার পর স্যমন্তক বলল, ‘আপনি যে আমার সঙ্গে এসেছেন সে কথা ছোটোমা জানেন?”

—নাহ। উনি এখন মেডিটেশনে বসেছেন। কোনও দিকে মন দেবেন না। তাই চলে এলাম আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে। —যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা প্রশ্ন করব?

—করুন।

—কাকু না হয় অন্যায় করেছেন ছোটোমার সঙ্গে। কিন্তু মিতিন? সে তো তাঁর সন্তান। তাহলে মিতিনের প্রতি এতটা উদাসীন কীভাবে হয়ে গেলেন ছোটোমা? বিষয়টা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকল।

ধীর গতিতে হাঁটছিল ওরা। এবার থেমে গেল তন্দ্রা। পথে লোকজন বিশেষ নেই। সকালে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ এখনও মেঘলা। রাস্তার পাশের রাধাচূড়া গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে স্যমন্তকের দিকে তাকাল সে। বলল, “আপনি আপনার কাকু আর ছোটোমা সম্পর্কে কতটা জানেন স্যমন্তক?’

—না মানে তেমন কিছুই আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। বললাম না আপনাকে কাকু সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাকু ফিরে আসায় একটু আধটু জেনেছি। ইতস্তত করে উত্তর দিল স্যমন্তক।

—একটু আধটু নয়, আপনি আসলে কিছুই জানেন না। আপনার কাকু মানে স্নেহাংশু সরকার আপনাদের বাড়ি ছেড়ে আসার পর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে থাকা শুরু করেছিলেন মিতিনকে নিয়ে। মাঝে মাঝেই তিনি হানা দিতেন মাসিমণির বাসায় আর নানা বাহানায় টাকা নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় টাকা চাওয়ার কারণটা হতো মিতিন। মাসিমণি অনেক খোঁজখবর করে তার আস্তানার হদিশ বের করেছিল দু’একবার কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা পাওয়া যেত না কারওর। প্রত্যেকবার টাকা নিয়ে যাবার পর নিজের ঠিকানা বদলাতেন স্নেহাংশু। আত্মীয়স্বজনদের মুখে শুনেছি মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্যে পাগলের মতো করতেন মাসিমণি। কিন্তু আপনার কাকু কোনওদিনও সে সুযোগ দেননি মাসিমণিকে। শুধু দিনের পর দিন হাত পেতে টাকাই নিয়ে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন মাসিমণি। কমিয়ে দিয়েছিলেন গান গাওয়া।

—এসব কথা তো আমি…

—এখানেই শেষ নয় স্যমন্তক। গল্প আরও আছে। মাসিমণির সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম হাওড়ায় এক কনসার্টে। সেখানে হঠাৎই দেখা হয়ে যায় পাপিয়ামাসির সঙ্গে। পাপিয়ামাসি মাসিমণির ছোটোবেলার সঙ্গী। একসঙ্গে গান শিখতেন স্নেহাংশু সরকারের কাছে। তিনি কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের নার্স। তাঁর মুখ থেকেই মাসিমণি শুনেছিলেন সেই চরম সত্যিটা যেটা দিনের পর দিন আপনার কাকু লুকিয়ে রেখেছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে।

—চরম সত্যি? সেটা কী ?

ভ্রূ কুঁচকে তন্দ্রার দিকে তাকাল স্যমন্তক। বুজে আসা গলায় তন্দ্রা যে-কথাটা বলল সেটা শোনার জন্যে একটুও প্রস্তুত ছিল না স্যমন্তক।

—মিতিন আর বেঁচে নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার পরপরই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় মিতিন। পাপিয়ামাসিদের হাসপাতালেই ভর্তি ছিল সে। আপনার কাকু বানিয়ে বানিয়ে মাসিমণির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রচুর গল্প বলেছিলেন পাপিয়ামাসিকে। তাঁর চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়েটা। অথচ স্নেহাংশু সরকার দিনের পর দিন সেই মৃত মেয়ের নাম করে টাকা নিয়ে আসছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে। আজও আপনাকে পাঠিয়েছেন সেই একই কারণে। মিতিনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই গান গাওয়া ছেড়ে দেন মাসিমণি। শান্তির খোঁজে পা বাড়ান আধ্যাত্মিকতার পথে। পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে আশ্রয় নেন এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায়। চলে যেতে চেয়েছিলেন। স্নেহাংশুর ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু টাকার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সেখানেও পৌঁছে গিয়েছে ওই ঠগবাজ লোকটা। নিজে আসতে না পারলেও পাঠিয়ে দিয়েছে আপনাকে।

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...