অনেক মহিলাই চান না একাকী সন্তানের পুরো দায়িত্ব বহন করতে। কিন্তু যখন পরিস্থিতি কোনও নারীকে এই দায়িত্ব বহন করতে বাধ্য করে, তখন শত সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়েও সর্বশক্তি এবং সাহসিকতার সঙ্গে সন্তানকে মানুষ করতে কোনও দ্বিধা তারা করেন না।
সমস্যা আসবেই
আজও অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে যে, একলা থাকা যারা বেছে নেন তারা কি পারিবারিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এই জীবন বেছে নেন? কিন্তু এই জীবনের রাস্তা সহজ নয়। একাকী থাকেন এমন কোনও মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে, লোকে শুধু দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ারই দোষ দেয় না। পথভ্রষ্ট, জেদি, রহস্যময়ী ইত্যাদি নানা উপাধিতে ভূষিত করতেও পিছপা হয় না। পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে Single woman-এর নৈতিক ব্যক্তিত্বর উপরেও কলঙ্কের দাগ লাগানো সকলেই সহজ বলেই ধরে নেয়।
৪৯ বছর বয়সি তিয়াসা একজন সোশাল কাউন্সিলর। কথায় কথায় তিনি জানালেন, ‘একাকী যুবতির জন্য নতুন শহরে গিয়ে বাড়ি খোঁজাটা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়। নিজের বয়স থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস, চেনাপরিচিতি বন্ধুবান্ধবের ঠিকুজি-কুষ্ঠি — সবকিছু তথ্য বাড়ির মালিককে জানাতে হয়। তা সত্ত্বেও অবিশ্বাসের স্ক্রুটিনির মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। একাকী যুবতির আচার-আচরণ, তার জীবনশৈলী, বন্ধুবান্ধব এমনকী দৃষ্টিভঙ্গির উপরেও আঙুল তোলাটা লোকে নিজের অধিকার ভেবে নেয়।
এটাই মেনে নেওয়া সব থেকে সহজ যে, Single woman মানেই সে বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করে। সারা দিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, বাজে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেশে, বাড়িতে রান্না না করে রেস্তোরাঁ থেকে রোজ খাবার আনায় ইত্যাদি কতরকম লোকে ধরে নেয়। যে-কোনও সোশাল অনুষ্ঠানে অবিবাহিত যুবতিকে ‘বেচারা’ সম্বোধন করা হয়, তার সংসার হয়নি বলে।
পল্লবী কলকাতায় আইটি-তে কর্মরত। ওর সঙ্গে কথোপকথনে সে জানাল, ‘আমি সকলের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার জন্য একা থাকি না। কিন্তু এক এক সময় আমার আশেপাশে কারুর উপস্থিতি আমি একেবারেই চাই না। বিবাহিত লোকেদের জীবনেও নিশ্চই এরকম পরিস্থিতি কখনও না কখনও আসেই!’
৪২ বছর বয়সি শ্রেয়া পেশায় স্থপতি। প্রায়শই ওকে বিদেশে যেতে হয়। দেশে থাকলে সময় পেলেই মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটায়। শ্রেয়া জানালেন, “আমি বেড়াতে ভালোবাসি, আমার কাজ আমাকে সে সুযোগ করে দিয়েছে। এক জায়গায় থেমে থাকা জীবনে আমি বাঁচতে পারব না। শুধুমাত্র সামাজিক নিয়ম রক্ষার জন্য বিয়ে করার কথা কখনও আমার মাথাতেই আসেনি।’
৪৪ বছর বয়সি অনিন্দিতা মার্কেটিং কনসালটেন্ট। একাকী একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন এবং এই জীবনে তিনি খুশি। তিনি একজন Single woman। বিয়ে করেননি। তাঁর মতামত হল, “বিবাহিত জীবনের সবরকম সুবিধা এবং অসুবিধা ভালো করে বিবেচনা করে, তবেই আমি একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জীবন থেকে আমার চাহিদা অন্যদের থেকে আলাদা। বিয়ে হয়ে গেলে কেরিয়ার নিয়ে হয়তো কনসেনট্রেট করতে পারতাম না। তবে যেসব মেয়েরা সফল বিবাহিত জীবন কাটাবার আকাঙ্ক্ষা রাখে আমি কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে নই।’
‘বিয়ে না করা মানে সমাজ থেকে সরে যাওয়া নয় কিংবা সমস্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা নয়। এখন মাতৃত্ব পেতে পুরুষেরও প্রয়োজন নেই’, এমনটাই মানেন ৩৯ বছরের শ্রেয়া শর্মা। যিনি ৮ মাস আগে দেড় বছর বয়সি নেহাকে দত্তক নিয়েছেন। শ্রেয়া দু’জনের এই সংসারে যথেষ্ট আনন্দে রয়েছেন। রুপোলি পর্দার সুস্মিতা সেন এই ধরনের মানসিকতার খুবই পরিচিত একটি মুখ।
মানসিকতার পরিবর্তন
ধীরে ধীরে সমাজের মানসিকতায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হল স্ত্রী শিক্ষা এবং সমাজে মেয়েরা যে-জায়গায় নিজেদের পরিচিতি বানাতে সক্ষম হয়েছে। অন্তত বড়ো বড়ো শহরে মেয়েদের একা থাকাটা ‘বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে’ বলে ধরে নেওয়া হয় না। এটা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব ইচ্ছা। এখন অফিস এবং সংসার একসাথে সামলানো সম্ভব নয় ভেবে মেয়েরা বিয়ে করতে অস্বীকার করলে, তাদের অসুবিধাটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে। তাদের নিজেদের জীবন নিজের মতো করে কাটাবার সুযোগ দিচ্ছে।
একাকী বলে দুঃখ কীসের
একা যদি কেউ জীবন কাটাতে চায় তার একটা কারণ, সে নিজের পরিচিতি হারাতে চায় না। যেসব মহিলা একা জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হল — পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে পুরোপুরি সম্মান, সহযোগিতা এবং ভালোবাসা পাওয়া। অনেকেই একা ছেড়ে অপর কারও সঙ্গে থাকার কথা চিন্তাই করতে পারে না। কখনও তাদের মনেই হয় না তারা একা জীবন কাটাচ্ছে। তাদের বন্ধু, পরিবারের সদস্যরা সবসময় সাপোর্ট করছে। এমনকী কোনও উৎসব, অনুষ্ঠানেও সবাই একসঙ্গে এনজয় করছে।
Single woman-দের আজ মানসিকতাই হল, আমি একা আছি তো কী হয়েছে। আমার এতে কোনও দুঃখ নেই। বিয়ে করাটাই শুধু পরিচয়পত্র হতে পারে না। আমার ইচ্ছা, রুচি, স্বাধীনতা আমার কাছে অনেক বেশি প্রিয় এবং জরুরি।
শহুরে আবহাওয়া, ফাস্ট লাইফস্টাইল, পুরোনো ধ্যানধারণায় পরিবর্তন – এসব কিছুই সিংগল উয়োম্যান কনসেপ্ট-কে আরও এগিয়ে নিয়ে এসেছে। মানুষের জীবনশৈলীতে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে। এখন একাকী কোনও নারী বা পুরুষ বাস্তবে একাকী নয়। তারা নিজেদের মধ্যে মেলামেশা করে, ঘুরতে যায়, একে অপরের বাড়িতেও যায়। এই কারণেও বিয়ে করার বা সংসারধর্ম পালন করার কোনও প্রয়োজন তারা উপলব্ধি করতে পারে না।