ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। এই ধ্বনির মধ্যে কী যেন আবেশ জড়িয়ে আছে। জড়ানো মোহ আছে, মন অন্য হয়ে যায়। এবছরই গরমে দিবার সাথে গিয়েছিল বর্গভীমা মন্দিরে। সেখানে এই ঘণ্টাধ্বনি, ধূপ-দীপ, আশ্চর্য গন্ধ তাকে স্থানু করে রেখেছিল প্রায় একবেলা। আসতেই ইচ্ছে করছিল না। সেই ধ্বনি।

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ঝামা পাথরের পঞ্চরথ পাঢ়া দেওল। চৌকো চৌকো পাথর বসিয়ে গাঁথনি। বহু যুগের শ্যাওলা জমা। ডাইনটিকরির লোকেরা বলে সাত আটশো বছরের পুরোনো তো হবেই। মন্দির কাছাকাছি হতে একটা ভয়ও কুড়ানির ভেতর, যদি কোনও কারণে কোনও ত্রুটি হয়। দূর থেকে সিঁদুরলিপ্ত পাথরে গুড়িসুড়ি মেরে ঢুকে পড়ছিল। অষ্টভুজা মা-র কাছে যাবে, যদি একটা আবছা অবয়ব দেখে। ক্রমে তা গাঢ় হয়। ওড়িয়া ব্রাহ্মণের দুর্বোধ্য মন্ত্রপাঠ কানে যায়। বোঝে না। পূর্বমুখী মন্দির। দরজায় দাঁড়াতেই ভেতরে ছায়া পড়ে। পুরোহিত ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলের থালি হাতে কুড়ানিকে দেখতে পান। ইশারায় বসতে বলেন।

স্থানীয় ভক্তদের মতো পূজারিও জানেন দেবী রঙ্কিণীর আসল বাসস্থান ছোটোনাগপুরের ঘাটশিলা। এই ভৈরবভূমিতে তিনি মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য আসেন। আসেন ওড়গন্ডায়। তবে পথে এই ডাইনটিকরির মন্দিরেও কিছুক্ষণের জন্য দেবী প্রতিষ্ঠিত হন। এই প্রতিষ্ঠাকে স্বীকৃতি দেবার জন্যই যেন এই ফুল দেয়া নেয়া।

ফেরার পথটা প্রায় উড়ে পার হতে চায় কুড়ানি। চারদিকে অদ্ভুত একটা গন্ধ। দুরের বাঁশঝাড়, বেনাবুদা, লাটকে লাট ধানখেত— সব চেনা ছবিও নতুন লাগছে।

ধানওঠা রুখা জমিগুলো, মাঝেমাঝে কাঁকরভরা রুগড়ি পাথরের লাল পথ লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। মকরসংক্রান্তির জন্য কাসাইয়ের তীরে মেলা বসেছিল। কুড়ানি এক বান্ডিল কাচের চুড়ি কিনেছে। চুড়িপরা হাত নাড়ালেই রিনরিন করে বাজছে। হাত তুলতেই নীল কাচের চুড়ি আলো ঠিকরোচ্ছে, খুশির।

একি আত্মপ্রকাশের আনন্দ? বুনো মকাই-এর খই-এর মতো ভেতরে ভেতরে ফুটছে। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে যায়। দুহাত জড়ো হয়ে মাথায় ওঠে। রঙ্কিণী মা-র জন্য নয়। মজুমদার মশাইয়ের প্রতি। তিনিই তো এইসব ব্যবস্থা করেছেন। সামান্য কুড়ানি এই একমেলা মানুষের মধ্যে আলাদা আসন পাবে এতো তারই দান। এই মানুষটিকে কুড়ানি কখনও দেখেনি। শুধু তার দানই পেয়ে এসেছে। শিলদায় মজুমদার মশাই-এর বড়ো দোকান। খড়গপুর শহরেও তার ব্যাবসা। বাস আছে। শুনেছে কলকাতায় তার ঘর আছে। তিনি পঞ্চায়েতেরও মাথা।

দূরপাল্লার এই বাসটা সেমি-ডিলাক্স। বাসে গান বাজছে। বচ্চনের। ‘মেরে অঙ্গনেমে তুমারা ক্যায়া কাম হ্যায়।’ অন্য সময় হলে মন দিয়ে শুনত। মাথা নেড়ে হিন্দি উচ্চারণ করার অক্ষম চেষ্টা করত৷ দ্রুতগামী বাস। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে যায় কুড়ানি। বাস স্টপের গায়েই ভৈরব থান। বাস থেকে নেমেই দিবাকে দেখতে পায়। ভৈরব থানের পাশে দাঁড়ানো। সাড়ে চার ফুট উঁচু মাকড়াপাথরের বেদী। বেদী সাজানো হয়েছে। আলপনা আঁকা। নানা মাটির মূর্তি বেদীতে। হাতি ঘোড়াই বেশি। উলটোদিকে ভৈরবের শক্তি রঙ্কিণী দেবীর থান। কালো পাথরে লাল কাপড় জড়ানো দেবীর অধিষ্ঠান। মাথায় সিঁদুর মাখানো। সামনে পুজোর ঘট। স্থানীয় মান্যজনেরা এসে গিয়েছেন। কুড়ানি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল ভীরু পায়ে। পুরোহিতের হাতে ফুলের থালি তুলে দিতেই মন্ত্র উচ্চারণ হল। ঢাকঢোল বেজে উঠল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, হরিতকী, বয়রা ঘেরা মাঠে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাঁওতাল খেরোয়াল আদিবাসী ভক্তরা সেজেগুজে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র আর বর্শা, টাঙি নিয়ে দাঁড়িয়ে। সামনের দিকে নাচের জন্য মেয়েরা। বাঁশ নাচে পারদর্শী ছেলেরাও। বেদীর পাশেই উঁচু মঞ্চে বসবার আয়োজন হয়েছে বিভিন্ন মান্যজনের। কুড়ানিরও ঠাই হল সেখানে।

কুড়ানি শুনেছে এই দেবীর মূর্তি আছে ঘাটশিলায়। কখনও সে দেখেনি। তাঁর মাথায় জটাজুট, আটহাত। উপরের দুটো হাত দিয়ে একটা হাতি ধরে আছেন। অন্যহাতে অস্ত্রশস্ত্র। শববাহন, রক্তমুখী, রক্তবর্ণা এই দেবী পশুরক্তে সন্তুষ্ট নন। তিনি নররক্ত চান। একসময় নরবলির রেওয়াজ ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালে হেজ সাহেবের হস্তক্ষেপে সে বলি বন্ধ হয়ে যায়। নরবলি দেয়া বন্ধ হলেও কুড়ানির মা বলত দেবী নিজের হাতে নরহত্যা করে রক্তপিপাসা মেটাতেন। এখন মানুষের মূর্তি দেয়া হয় দেবীর কাছে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...