পর্ব ২
“শিল্দা শিল্দা আইছে। নামবে আস।' বাসের হেল্পার কাম্ কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে উঠল। হুড়মুড় করে একগাদা মানুষ হাঁড়িকুড়ি ছানাপোনা, পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নেমে যায়। আর একদল ওঠে। বাস ছেড়ে দেয়। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে বীণপুরের উদ্দ্যেশে চলে ঝাড়গ্রামগামী বাস। বীণপুরে অনেকটা সময় দাঁড়ায় বাস। চা-জলখাবার খায় ড্রাইভার, যাত্রীরা।
সূর্য উঠে পড়েছে আলসেমি ছেড়ে। কাঁচারাস্তায় বাস হুহু করে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে মহুয়া, শাল, বহেড়া গাছ রোদ মাখছে। শীত আর নেই। বেশ ভালো লাগে কুড়ানির। অন্যদিনের মতো সকালে পান্তা খায়নি। আজ উপোস। কিন্তু খিদের কথা মনেই আসছে না আজ। এমনিতে খিদে সইতে পারে না। ভারী শরীর। কাজও যেমন করে, খায়ও গবর গবর। শরীরও তাই বাঁধানো ঘাটের মতো। দিবা বাগ যখন তখন বাঘ হয়ে উঠেও কিছু জৌলুস কমাতে পারেনি। বরং কুড়ানিই শরীর পেতে আশ্রয় দেয়, যথেচ্ছ ব্যবহারের আনন্দ দেয় শান্তভাবে। দিবা উঠে গেলে পালদের পুকুরে একটা ডুব মেরে শরীর ঠান্ডা করে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।
বাসের দুলুনিতে ঝিমুনি এসেছিল। দুটো গরু রাস্তার উপর হঠাৎ উঠে আসায় ড্রাইভার হাওয়া-ব্রেক মারে। বাসশুদ্ধ লোক হুড়মুড় করে এ ওর গায়ে। কুড়ানি পড়ে যাবার আগেই ডানহাত ইঞ্জিনের উপর উঁচু জায়গায় আটকে যায়। হাওয়াই চটি ছিটকে যায়। কুড়ানি লজ্জা পায়। মুখে লাজুক হাসি। এদিক ওদিক তাকায়। পা দিয়ে চটিটা টেনে নিয়ে কোনওক্রমে পায়ে গলিয়ে ফেলে। আসলে এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই অনেকদিন। আর রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। সকালে উঠতে হবে, ভোরের প্রথম বাস ধরতে হবে এই ভেবে।
ছেলেবেলায় মার সাথে খুব ভোরে উঠত। উঠে জলা-জায়গায় যেতে হতো খড়িকাঠি চুপিচুপি আনতে। মা-র মুখে শুনেছে বাবা পানু ঘোড়ই খুব বড়ো খড়িয়াল ছিল। বাবারা এখানে থাকত না। সবং-এ থাকত। সেখানে নদী ছিল, চণ্ডী নদী। কেলেঘাই-এর শাখানদী ওটা। বাবাদের গ্রামের নাম ছিল শ্যামসুন্দরপুর। মজা- নদীর চরে খুব সরু সরু খড়িগাছ হতো। গাছ কেটে শুকিয়ে ঝোড়া বুনত ওরা। দেখতে বেতের কাঠির মতো। খুব সুন্দর বুনোট। ঝোড়ার কানার দিকে অনেকটা মোটা বেষ্টনী থাকত, ধরার সুবিধার জন্য। স্থানীয় বাজারে শুধু নয়, বাইরেও চালান যেত সে সব। খুব কদর ছিল। বাবার খুব নামডাক ছিল একাজে। মা গেঁওখালির পাল্টি ঘর। কাজ জানত। বাবা মরে গেলে কেন যে সে কাজ উঠে গেল, কেনইবা এখানে এল ওরা, তা এক রহস্য।