ঘড়িতে সবে সাড়ে ৯টা। আমাদের বোলেরো জিপ রাউরকেলা টাউনশিপ থেকে স্টার্ট করে ৮ কিমি দুরে মিউনিসিপাল পৌঁছোল মাত্র ১৫ মিনিটে। জিপ এবার বাদিকে ঘুরে কয়েক কিলোমিটার এগিয়েই ঢুকে পড়ল রাউরকেলা স্টিল প্ল্যানটের ফার্টিলাইজার টাউনশিপ-এ। গাড়ির গতি মধ্যম, আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম লাঠিকাটা। হালকা জঙ্গলের শুরু এখান থেকে৷  ছোট্ট ছুটিতে অনেকেই প্ল্যান করেন পাশের রাজ্য ওড়িশার কিছু স্বল্পখ্যাত টুরিস্ট স্পট দেখে নেওয়ার। এমনই উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরাও চলেছি ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত দার্জিং-এর দিকে।তবে এ সফর শীতে আরও মনোরম হতো৷

জাতীয় সড়ক ২৩-এর দুই পাশে জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে। রাস্তার স্থানে স্থানে পিচ ওঠা, অবস্থা খারাপ। এপথে জিপ ছাড়া অন্য গাড়ি বিশেষ চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে দেখা যায় ডাম্পার চলেছে পথের লাল ধুলো উড়িয়ে। জঙ্গলঘেরা পাহাড়ি পথে মাঝে মাঝে লোকালয়, আদিবাসী অধ্যুষিত। পেরিয়ে এসেছি চাদিপোশি, বাস্তি নামের ছোটো ছোটো গ্রাম। পার হলাম ব্রাহ্মণী নদীর ওপর একটি ছোটো সেতু। ভারি সুন্দর, নির্জন বন্য পরিবেশ। গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে নেমে এলাম।

সামনে পাহাড়ঘেরা জঙ্গলময় উপত্যকা। পাশে বয়ে চলেছে নদী। পথের দু’পাশে শাল-পলাশের জঙ্গলে লাল ধুলোর আস্তরণ। আরও কিছুটা এগিয়ে ড্রাইভার সন্তোষ জিপ দাঁড় করাল ছবির মতো সুন্দর এক জায়গায়। পাহাড় নদী ও জঙ্গল নিয়ে জায়গাটির নাম দার্জিং, রাউরকেলা থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে। আমরা এসেছি জাতীয় সড়ক ২৩ ধরে। এই পথ দার্জিং পেরিয়ে রাজামুন্ডা গ্রাম হয়ে পৌঁছোবে ৬০ কিমি দূরের লাহুনিপাড়া তহশিলে। সেখান থেকে দুটি ভিন্ন পথ গেছে কাল্টা ও টেনসায়।

শীতে দার্জিং-এ পিকনিক পার্টিদের ভিড় থাকে। এখন ফাঁকা৷ আমরা ছাড়া এসেছে ৩-৪ জন স্থানীয় আদিবাসী যুবক, দুটি মোটর সাইকেলে। চাদর বিছিয়ে আমরা যে-জায়গায় বসলাম তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ব্রাহ্মণী নদী। শীতে সে শীর্ণকায় হয়ে যায়। তার বিস্তৃত বালুকাময় চড়ার মাঝ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলে কয়েকটি ছোটো জলধারা। কী অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। অদূরেই অনুচ্চ পাহাড়, জঙ্গল। সেখানে বিরাজমান অপার নীরবতা।

 Odisha Darjing travel

দার্জিং-এ বেড়াতে এসে পিকনিকটাও সেরে নিচ্ছি হটকেস-এ আনা চিলি চিকেন-ফ্রায়েড রাইস-এ। এখান থেকে আরও ২ কিলোমিটার এগোলেই দেওধর গর্জ। দুই পাহাড়ের মাঝে বহমান নদীতে যথেষ্ট জল এই শীতেও। পরিবেশের অখণ্ড নীরবতাকে নষ্ট না করে আমরা প্রায় নিঃশব্দেই লাঞ্চ সারলাম দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম পিডব্লুডি-র ইন্সপেকশন বাংলোর কাছে। আরও কিছুটা অমূল্য সময় কাটিয়ে উঠে বসলাম জিপ-এ। একই পথে লাঠিকাটা পার হয়ে ফিরে এলাম রাউরকেলায়।

পানপোশ চক পেরিয়ে গাড়ি চলে এল ব্রাহ্মণী নদীর ওপর তৈরি ব্যস্ত সেতুতে। বেদব্যাস চক-এ পৌঁছে গাড়ি ডানদিকে মোড় নিয়ে মাত্র আধ কিলোমিটার এগোতেই আবার ব্রাহ্মণী নদীর তীরে বেদব্যাস মন্দিরে। এই মন্দির রাউরকেলা থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে। মন্দির থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নদী পর্যন্ত। বায়ে তাকালে চোখে পড়ে শঙ্খ ও কোয়েল নদীর সঙ্গম। ঝাড়খণ্ড থেকে বয়ে আসা নদী দুটি বেদব্যাসে মিলিত হয়ে জন্ম দিয়েছে ওড়িশার অন্যতম প্রধান নদী ব্রাহ্মণীর।

নদী বেশ চওড়া এখানে। কিংবদন্তী অনুযায়ী, ব্যাসদেবের জন্ম এইস্থানে এবং তাঁর নামে মন্দিরও। কাছেই নদীতীরে এই অঞ্চলের একমাত্র মহাশ্মশান। শিবরাত্রিতে মন্দিরের পাশে রাতভর মেলা বসে। বেদব্যাস চকে ফিরে এলাম দুপুর আড়াইটে নাগাদ। এবার সম্বলপুরগামী রাজ্য সড়ক ১০ ধরে এগিয়ে চললাম। গাড়ির গতি বেড়েছে। পার হলাম কংসবহুল টাউনশিপ, তারপরই কলুঙ্গা, আরও কিছুদুর এগিয়ে গাড়ি রাজ্য সড়ক ছেড়ে ডান দিকে মোড় নিল।

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...