খানিক পরে কাকলি নিজেই আবার শুরু করেন, ‘এখন ভেঙে পড়ার সময় নয়, বরং ভুল শোধরানোর সময় এসে গেছে। কাকলি ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালিকের একমাত্র ছেলে আশ্রমে পড়ে থাকবে। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।’

‘আর কাকলি?’

‘কাকলিও আমাদের সাথে থাকবে।’

‘তুমি…’ নীহারেন্দুবাবুর সব শব্দ কে যেন ছিনিয়ে নেয়। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকেন স্ত্রীর দিকে।

‘এভাবে দেখার তো কিছু নেই নীহারেন্দু। হ্যাঁ হতে পারে তোমাদের বিয়েটা হয়নি কিন্তু তবু অধিকারটা তোমার উপর তার অনেক বেশি। আমি এখন এসব নিয়ে ভাবছি-ই না, আমার শুধু একটাই চিন্তা সমস্ত কিছু জানলে ও আমায় ক্ষমা করবে তো? আমার ছেলেও কি আমায় মেনে নেবে? জানি না কিছুই জানি না। সময়ই সব বলবে।’

সারারাত দু-চোখ এক করতে পারেনি দুজনে। ভোর ভোর উঠে তৈরি হয়ে দুজনে সোজা আশ্রমের পথে রওনা দেন। দুজনের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। গুরুজিকে সমস্ত কিছু জানিয়ে দুজনে সোজা কাকলির কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা বাইরে থেকে খোলা। দরজার থেকে একটু বাঁক ফিরলেই কাকলির বেড। জানালা দিয়ে হালকা রোদ পড়েছে কাকলির বেড-এ। হাসিমুখে এগিয়ে যান কাকলি। কাকলিদেবী কাকলিকে ঢুকতে দেখে বেশ অবাকই হন!

‘এত সকালে?’

‘আজকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’ কাকলিদেবী কিছু বলার আগেই কাকলি দরজার দিকে তাকিয়ে একটু জোর করে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘নীহারেন্দু ভিতরে এসো।’

এক পা এক পা করে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াতেই সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল কাকলিদেবীর। বিস্ময়ে আনন্দে দু-চোখ জলে ভরে গেছে। কত কী যে বলার আছে, কিন্তু মুখ দিয়ে একটি কথাও সরছে না। বিছানা থেকে শরীরটাকে কোনওমতে তুলে নীহারের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে শাড়ির আঁচলে পা-টা জড়িয়ে একেবারে পড়ার মতো অবস্থা। ছুটে এসে সামলে নেন নীহারেন্দুবাবু। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। চোখের তারা একেবারে স্থির। এইভাবেই কেটে যায় মিনিট পাঁচেক, নিজের উপস্থিতি বোঝাতে কাকলি একবার কেশে ওঠেন। চমকে ওঠেন নীহারেন্দুবাবু। তিনি বোধহয় এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলেন তাঁর বিবাহিতা স্ত্রীও সেখানেই উপস্থিত রয়েছে। কাকলীদেবীকে বিছানায় বসিয়ে দেন তিনি। ঠিক সেই সময়েই ঘরে ঢোকে ঋতম। মা-র কেবিনে ম্যাডামকে দেখে অবাক হয়ে যায় সে।

বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে বসে, ‘আপনি এখানে?’

ম্যাডামকে প্রশ্ন করার আগেই মা-র পাশে বসে থাকা ভদ্রলোকের দিকেও চোখ গিয়েছিল ঋতমের। ঠিক তখনই কাকলীদেবী ছেলেকে কাছে ডেকে বলেন, “ইনি তোমার বাবা। প্রণাম করো।’

কথাটা শোনামাত্রই ছিটকে কয়েক কদম পিছিয়ে যায় ঋতম। বেশ কর্কশ ভাবেই বলে ওঠে, কী করতে এসেছেন এখানে? এতদিন পরে দেখতে এসেছেন আমরা বেঁচে আছি কি মরে গেছি? যখন ওনার প্রয়োজন ছিল তখন উনি কোথায় ছিলেন? আমার মা-কে আমি-ই দেখতে পারব, কারওর প্রয়োজন নেই। প্লিজ চলে যান।’

ঋতমের কথা শেষ হওয়ার আগেই কাকলি ম্যাডাম জবাব দেন, ‘তোমার বাবার কোনও দোষ ছিল না ঋতম।’

‘প্লিজ ম্যাডাম এটা আমার ফ্যামিলির ব্যাপার। আপনি এর মধ্যে ঢুকবেন না।’

“আমিও তো তোমার ফ্যামিলির মধ্যেই পড়ি। আমি যে তোমার বাবার বিয়ে করা স্ত্রী।’

কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই চমকে ওঠে ঋতম। সঙ্গে কাকলিদেবীও। অবলীলায় ঋতম বলেও ফেলে, ‘সেই কারণেই ইন্টারভিউয়ের সময় আপনি…’

“ঠিক তাই। তোমাকে দেখা মাত্রই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল আমার। শুধুমাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খানিকটা সময় নিয়েছিলাম ব্যস এই যা। আমার জানার ছিল তোমার বাবা যখন তোমার মা-কে ছেড়ে চলে যান তখন কি তিনি জানতেন তোমার মা প্রেগন্যান্ট ছিলেন। আমার ধারণাই ঠিক। আমি মানুষটাকে ঠিকই চিনেছি। জানলে উনি কখনওই তোমার মা-কে ছেড়ে যেতেন না। শুধুমাত্র সময়ের ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন।’

“তার মানে মা-র সম্পর্কে আপনি সমস্ত কিছুই জানতেন?”

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...