নন্দু আর আমি যখন নতুন দিল্লি স্টেশনে এসে আমার কেবিনে উঠলাম তখন আমার দু’বার্থের কুপেতে আর কোনও যাত্রী ছিল না। নন্দু বলল, “তুমি খুব লাকি দাদু। এমন নিরিবিলি একটা কুপে জায়গা পেয়ে গেছ। আমারও যেতে ইচ্ছে করছে।’
আমি হেসে বললাম, “চল না, তোরও টিকিট করে দিচ্ছি।’ নন্দু হেসে বলল, ‘নেক্সট টাইম দাদু’, বলে নন্দু ঘড়িতে সময় দেখে নীচে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেল। আমিও দেখে খুব খুশি হলাম। ভাবলাম, সদ্য ডাকে পাওয়া শ্রী অরবিন্দের লাইফ-ডিভাইন বইটা শুরু করা যাবে। নিরিবিলি ছাড়া এ বই পড়া যায় না। রেল কোম্পানির দেওয়া চাদরটা পেতে জমিয়ে বসতে যাব এমন সময় এক বিদেশিনি মহিলা স্মিত হেসে বিনীত নমস্কার জানিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আমি সৌজন্যের খাতিরে সামান্য উঠে দাঁড়িয়ে, ‘বাও’ করে, প্রতি-নমস্কার জানিয়ে বসতে আহ্বান জানালাম ।
ভদ্রমহিলা দামি বিদেশি ব্যাগ খুলে নিজের জিনিসপত্র সামান্য গোছগাছ করে নিয়ে সিটের উপর রেখে প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকের জানলার দিকে মুখ করে বসলেন। একে তো বিদেশি তায় বাইরে থেকে এসেছেন— তাই বুঝি সামান্য গরম লাগছিল। হাতব্যাগ থেকে একটা ছোটো তোয়ালে বের করে গলা, ঘাড় ও মুখের হালকা ঘাম মুছে নিলেন।
প্ল্যাটফর্মের বাইরে কয়েকটি কাক আর কুকুর হাইড্রেন্ট-এর জলে পরমানন্দে স্নান করছিল। ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে ছোটো ক্যামেরাটা বের করে ক্লিক ক্লিক করে কয়েকটা ফটো তুলে নিলেন। আমার দিকে চোখ পড়ায় স্মিত হেসে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘দে আর এনজয়িং।”
নন্দু, আমার পড়শি আর বন্ধু অবিনাশের নাতি আমাকে স্টেশনে ছাড়তে এসেছিল। বলেছিলাম, কোনও দরকার নেই, আমি ট্যাক্সি নিয়ে একাই স্টেশনে পৌঁছে যাব, তারপর তো কুলিরাই যা করবার করবে। কিছুতেই শুনল না; বলল, “কোনও প্রবলেম নেই দাদু, আমি তো আজ সম্পূর্ণ ফ্রি। তাছাড়া একটু ঘোরাও হয়ে যাবে, কতদিন রেলস্টেশন দেখিনি!’ কথাটা ঠিক। আজকালকার ছেলেমেয়েরা রেলে আর চড়ে কোথায়?
নন্দু’র সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলছিলাম। কয়েক মিনিট পরেই ট্রেন চলতে আরম্ভ করল। নন্দু প্রণাম করে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। ক্রমশ চেনা দৃশ্যপটগুলো বদলাতে লাগল। প্রথমে আস্তে পরে খুব দ্রুত। সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে দেরি ছিল না। আসলে যতক্ষণ প্ল্যাটফর্মের ভিতরে ছিলাম মনে হচ্ছিল বুঝি অনেক রাত হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে বুঝলাম তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে শহরের বুকে। কেবল দিনের উজ্জ্বল রং ধুয়ে আকাশ একটু ফ্যাকাশে হয়েছে কিন্তু দু’পাশের রাস্তার আলো জ্বলা শুরু হয়ে গেছে। এয়ারকন্ডিশন কুপেতে অবশ্য আলো অনেক আগে থেকেই জ্বলছিল।
দিন-রাতের এই সন্ধিক্ষণে চলন্ত ট্রেনের জানলা পথে তাকিয়ে চেনা-জানা জায়গাগুলো পিছিয়ে যাওয়া দেখলে কেমন যেন মনে হয় আমিও পিছনপানে ধেয়ে চলেছি কোথাও! এ একটি ভীষণ রোমান্টিক অনুভূতি, আর গভীর রাতের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে তীব্র গতিতে ধেয়ে চলা রেল গাড়ির মাদকতার যেন তুলনাই নেই। এই মাদকতা অনুভব করার লোভেই আমি হাওয়াই জাহাজ ছেড়ে ট্রেনে যেতেই বেশি পছন্দ করি। প্লেনে গেলে মনে হয় ‘সফর’টা ফুডুত করে ফুরিয়ে গেল। পাশে বসে থাকা মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হবার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু ট্রেনে তা নয়— ভ্রমণটা যেন মনভরে উপভোগ করা যায়। সহযাত্রীদের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করা বা আড্ডা মারা তো উপরি পাওনা।