ইতিমধ্যে খবর পেয়েছিলাম, ও এক আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেছে আর অনেক বড়ো বড়ো নামিদামি পুরস্কার পেয়েছে। পুরস্কারের কথা তো খবরের কাগজ, রেডিও-টিভি মারফত পেয়েই যেতাম। বড়ো বড়ো সেমিনারে যখন দেশে আসার খবর পেতাম তখন আমি সবার শেষে ‘হলে’ পৌঁছে একেবারে পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসতাম। কখনও সখনও চোখে চোখ পড়ে গেলে কেবল হাত তুলে ‘হাই” জানাত। ব্যস ওই টুকুই- শুধু চিনতে পেরেছে এটুকুই জানিয়ে দেওয়া।

আমাদের মধ্যে তফাতটা অনেক বেশি হয়ে গেছে। আকাশ পাতাল না হলেও যেন সমুদ্র আর ঢাকুরিয়া লেক! আমি সেমিনার শেষ হবার কয়েক মিনিট আগেই বেরিয়ে পড়তাম যাতে ওর সঙ্গে দেখা না হয়ে যায় আর ও অপ্রস্তুতে না পড়ে যায়। কেন-না ওর পক্ষে আমার জন্য সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। সব সময়ই কেউ না কেউ কাছাকাছি ঘিরে থেকে বার্তালাপ করতে ব্যস্ত থাকত।

আজ এই টাইম ম্যাগাজিনে ওর কৃতিত্বের কাহিনি পড়ে আমার নিজেকে গর্বিত বোধ হচ্ছিল এই ভেবে যে, একদিন আমারা দু’জন কত কাছের বন্ধু ছিলাম। একই কামরাতেই থাকতাম দিনরাত।

ওর স্ত্রী-পুত্র থাকা সত্ত্বেও আবার একটা আমেরিকান মেয়ে বিয়ে করাটা জানা-শোনা মহল সমর্থন করত না। অনেকরকম সমালোচনা আর নিন্দাবাদ করে শান্তি পেত। সরবে প্রচার করত, সেই “অবিচার আর অন্যায়ের’কাহিনি। আমার কিন্তু একবারও মনে হয়নি যে শুভ, জানকী আর পুত্র রাহুল-এর প্রতি অবিচার করেছে। শুভ তো ওদের নিয়ে যেতেই চেয়েছিল কিন্তু ওরাই তো দেশ ছেড়ে অতদূর বিদেশে যেতে চায়নি। বিশেষ করে সম্পূর্ণ নিরক্ষর আর গ্রামের মেয়ে জানকীর সাহসহীনতা।

আবার ওদেশে নোঙ্গর-বিহীন নৌকা হয়ে থাকাও যায় না। আর উপরে উঠতে গেলে যে অনুপাতে সামাজিক সিঁড়ি চড়তে হয় সে অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ কোনওটাই শুভ’র ছিল না। তাছাড়া শুভ’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই এমন ছিল যে ওর প্রার্থিত জিনিসের সামনে যে-কোনও বাধাই ও সুনামি’র বেগে অতিক্রম করে চলে যেত। তাইতো যখন প্রফেসর স্যান্ডারসনের কাছ থেকে ডাক এসেছিল। তখন তাতে সাড়া দিতে ওর এক মিনিটও সময় লাগেনি।

টাইম ম্যাগাজিনে শুভ’র গড়া ওর গ্রামের স্কুল আর আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলিরও অনেক উল্লেখ আর প্রশংসা করেছে বড়ো করে। গ্রামের স্কুল ওর বাবার নামেই করেছিল। এইসব প্রতিষ্ঠানই ওর কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য পেত, এখনও নিশ্চয়ই পায়। টাকার প্রতি লোভ ওর কোন দিনই দেখিনি।

ট্রেনটা জোরে চলতে চলতে হঠাৎ আস্তে হয়ে একেবারেই থেমে গেল। আমি মাথা নীচু করে স্টেশনের নাম পড়ার চেষ্টা করলাম অতি কষ্টে অল্প আলোতে নামটা পড়লাম, এলাহাবাদ। একটু পরে অবশ্য প্ল্যাটফর্ম থেকে সুর করে আওয়াজ এল, ইয়ে ইলাহাবাদ স্টেশন হ্যাঁয়। খুব বড়ো আর সুন্দর স্টেশন। মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগে একটা সেমিনারে এসেছিলাম এখানে। শুভও আসছিল আমেরিকা থেকে ওই সেমিনারে। ওই খুব আগ্রহ নিয়ে লিখেছিল — মিত্রসাব, আই ওয়ান্ট ইউ টু কাম, আই ওয়ান্ট টু সি ইউ। শুভ কিছুদিন থেকেই আমাকে ওই নামেই ডাকতে শুরু করেছিল। আর তখন সদ্য আমেরিকায় গেছে। কথায় কথায় ইংরাজি বলা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...