তখনও কিছু পুকুর ছিল, পুরোনো হলুদ নোনাধরা দেয়ালে অশ্বত্থ বটের শিকড়-বাকড়ের গভীর বুনোট ছিল। রেডিওতে মনের মতো গান ছিল, রাতের তারার মতো দিনের আকাশে তেরঙ্গা ঘুড়ি ফুটে থাকত। আর সাথে ছিল সাবেকি পুজো— সবকিছুই আমাদের ছিল। পাড়ার মাঠে বাঁশ পড়ত বোরোলিনের ক্যানভাসে ক্যাটক্যাটে হলুদ সবুজ বিজ্ঞাপন। পরের কটাদিন যেন কীভাবে উধাও হয়ে যেত!
এই পুজো আসার বাতাবরণেই ছিল আমাদের হাওড়া স্টেশন, দিনান্তের আকাশে হুইসিল বাজিয়ে শেষ ট্রেন চলে যেত প্রতিবার দশমীতে নীলকণ্ঠ পাখির উড়ে যাওয়ার মতো। পালটালো সময়, পালটানোই রীতি, শুধু বাঙালির ভ্রমণের সাথি হোল্ডলটাই আর খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু এত বছরের উদ্গ্রীব পা-গুলো আশ্বিনের পুজোর ছুটির গন্ধ নিয়ে কখনও ঢাকুরিপাসে বা হিমাচলের কোনও অখ্যাত গ্রামে পা ঝুলিয়ে বিশ্রাম নিতে চায়। আজও একই ভাবে রুকস্যাকে মেস্টিন গোছায়।
নয় জনের টিম ষষ্ঠীর দিন ট্রেনে করে হিমাচলের দিকে রওনা দিল। সময় সংকুলানের জন্য আমরা তিন সদস্য অষ্টমীর সকালের ফ্লাইটে ভায়া দিল্লি টু চন্ডীগড় হয়ে সিমলা যাব বলে রয়ে গেলাম। সপ্তমীর বিকেলে গোছানো পর্ব কমপ্লিট শেষ বারের মতো চেকলিস্ট মেলাচ্ছি। লম্বা টুর অনেক হাইটে উঠব তাই প্রতিটা আইটেমের ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ নজরদারি। হঠাৎ একতলা থেকে আমার নাম ধরে আর্তনাদ। ডাক শুনে দুড়দাড় করে একতলায় নেমে আসায় হ্যাজব্যান্ড বললেন— কিং ফিশারের সব ফ্লাইট বাতিল হয়েছে, পুণের এক কল সেন্টার থেকে ফোন এসেছিল এইমাত্র। মানে যাওয়া ক্যানসেল।
তখন স্মার্ট ফোন নেই তাই হার্ড কপি নিয়েই ধস্তাধস্তি চলল। অনেক কষ্টে সেই পুণেওয়ালিকে পাকড়াও করা হল ফোনে। বরের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম ফোন। নাটকের যবনিকা পতনের মতন হাঁউমাউ করে কেঁদেকেটে বললাম মোওসিজি কো অন্তিমবার দেখনে কে লিয়ে হামলোগোকা চন্ডীগড় যানা বহৎ জরুরি হ্যায়। প্লিজ আপ কুছ কর দিজিয়ে ম্যাম, প্লিজ! বর হতভম্ব মেয়েও তাই। নেক্সট ডায়লগ কী বলব নিজেও জানি না।
যাই হোক মেয়েটি একটু সময় নিয়ে আবেগ ঘন গলায় জানাল আমাদের তিনজনের জন্য অন্য ফ্লাইটের টিকিট বুক করছে সে। কিন্তু দিল্লি টু চন্ডীগড়ের টিকিট কোনও ভাবেই সে পারবে না। অতএব দিল্লি টু চন্ডীগড় আমরা সাঁতার কেটে যাব, না দন্ডি কেটে যাব— সেটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। উফ্ তাও দিল্লি যাওয়াটা তো কনফার্ম হল।
কলার উঁচু করে বললাম— এবার বাকিটা তোমার টার্ন। উনি শুধু বললেন কী সাংঘাতিক কাণ্ড! এমন পারো কী করে? তাই বলে নিজের মাসি কে! এত বছর সংসার করার পরেও জানলাম না আর কী কী পারো!
যাই হোক চেষ্টা চরিত্র করে কোম্পানির একটি ছেলেকে ধরল। সে বেচারা ফ্যামিলি নিয়ে তখন পুরীর সমুদ্রের হাওয়া খাচ্ছিল। তাও সে এজেন্সি মারফত দিল্লি থেকে সিমলা যাবার গাড়ি বুক করে দিল। মেসেজে ড্রাইভারের ফোন নাম্বার চলে এল। যাক কাল ভোর তিনটেতে উঠে মাভৈ বলে রওনা দেব।
দিল্লিতে নেবে তক্ষুনি গাড়ি স্টার্ট করতে হল। মাঝে লাঞ্চব্রেক নিয়ে প্রায় ১৩ ঘন্টার জার্নির শেষে, হিমাচলের প্রাণকেন্দ্র সিমলায় পৌঁছোলাম। আমাদের নির্ধারিত হোটেলে যখন ঢুকলাম তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা পেরিয়েছে। অতি আধুনিক সুসজ্জিত পরিষেবা দিয়ে আমাদেরকে বিছানার আশ্রয়ে বন্দি করে নিল হোটেল।
(ক্রমশ…)