স্কুলে থাকতেই শ্বেতার সঙ্গে ভাব হয়েছিল নিলয়ের। নিলয়ের বাবা আর্মিতে ব্রিগেডিয়ার। ওনার চাকরিতে ট্রান্সফার লেগেই থাকত। কাজেই জম্মু, পাঠানকোট, ঝাঁসি, ইটানগর ঘুরে এসে দিল্লির দ্বারকাতে সেন্ট্রাল স্কুলে ভর্তি হয়েছিল নিলয় বারো ক্লাসের পরীক্ষাটা দিতে। নিলয়ের সায়েন্স, শ্বেতার আর্টস, তবু ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার আগেই। কিন্তু শ্বেতার তো উইমেনস কলেজ, ছেলেরা ওখানে ভর্তি হতে পারে না। ওদিকে শ্বেতা কো-এডুকেশন কলেজে ভর্তি হতে গেলে প্রমিলা যে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবেন না তার নিশ্চয়তা কী?
প্রমিলা যখন ঠাকুরের আসনের সামনে জপ করতে বসেন শ্বেতা তখন ছাতে উঠে ফোনে কথা বলে নিলয়ের সঙ্গে। নিলয়কে বাড়িতে নিয়ে আসার সাহস হয়নি এখনও শ্বেতার কিন্তু মার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়টি এবং ওঁর ওসিডি-সহ নানারকম খ্যাপামি সবিস্তারেই নিলয়কে জানিয়েছে শ্বেতা। কলেজ যাওয়া শুরু করার পর থেকেই ওর মা যে আবার রাতে মাথায় জল ঢালতে শুরু করেছেন সেটাও নিলয়কে জানিয়েছে শ্বেতা।
—তুমি রাজি থাকলে তোমার বাড়ি এসে তোমার মার সঙ্গে কথা বলতে পারি আমি, নিলয় বলল শ্বেতাকে ফোনে একদিন সন্ধের দিকে। -একদম নয়! মা তোমাকে রেপিস্ট ভেবে যে ঠ্যাঙাতে শুরু করবেন না বা গায়ে গরম জল ঢেলে দেবেন না তার কোনও সিওরিটি নেই। —কিন্তু ওনার তো ঠান্ডা লেগে আবার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে!
—হাসপাতালে কয়েকদিন পড়ে থাকলে যদি এই পাগলামি বন্ধ হয়ে যায় তবে আমি বেঁচে যাই।
—না না, সেটা ঠিক হবে না। যে কারণে উনি এসব করছেন সেটা তো আমরা জানি। ওনার মনে তোমার সম্পর্কে যে ভয়টা সব সময় কাজ করে সেটাকে দূর করতে পারলে হয়তো….
—সেটা সহজ কাজ নয় নিলয়। ফর হার, এভরি মেল ইন দিল্লি ইজ আ পোটেনশিয়াল রেপিস্ট। এই মাইন্ডসেট কী করে পালটাবে তুমি? -তোমার হয়তো ক্যারাটে কিংবা বক্সিং শেখা উচিত ছিল।
—মার চাপে পড়ে সে চেষ্টা যে একেবারেই করিনি তা নয়। দু’বছর স্কুলের পর পাড়ার মাঠে একজন মহিলা ব্ল্যাকবেল্টের কোচিং-এ হাত পা ছুড়েছি আমি। কিন্তু আমাদের হাত পা ছোড়া দেখতে যখন পাড়ার ছেলেরা মাঠের পাশে ভিড় করতে লাগল, তখন মা আমাকে উইথড্র করে নিলেন। কলেজে বক্সিং বা রেসলিং শেখার সুযোগ নেই, নইলে মাকে আশ্বস্ত করার জন্য ওগুলোও ট্রাই করতাম।
ওরা দু’জনেই হাসল। সিঁড়িতে মা-র গলার আওয়াজ পেয়ে এখন ছাড়ছি, পরে কথা বলব বলে শ্বেতা মোবাইল সুইচ অফ করে সিঁড়ির দিকে এগোল।
সে রাতে শুতে যাবার আগে শ্বেতা মাকে বলল, “আমাকে তো তুমি ঘর থেকে বেরোতে দেবে না আর কলেজে পড়াশোনা না করলে আমি চাকরিও পাব না। এই মাঝরাতে চান করে করে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে মরবার আগে তুমি বরঞ্চ আমার বিয়েটা দিয়ে দাও মা।’ প্রমিলা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ কী বলছিস তুই? তুই তো এখনও কুড়িতে পা দিসনি!”
—তাতে কী হয়েছে? শক্ত সমর্থ কোনও জোয়ান পুরুষের হাতে আমাকে তুলে দিতে পারলে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারবে। —না না তা হয় না। পড়াশোনা করে চাকরি করে তবে বিয়ে করবি তুই। আজকাল ছেলেদের কোনও ভরসা নেই, কথায় কথায় ডিভোর্স হয়ে যায়।
—তোমাদের সময়ই-বা ছেলেদের কী ভরসা ছিল মা? তোমার বরও তো তোমাকে ছেড়ে দিল মাঝ রাস্তায়।
—ওটা অন্য ব্যাপার। আমার কপালে যা ঘটল তারপর কোন ছেলে সাহস পেত আমাকে নিয়ে ঘর করতে বল? তবুও তো প্রতীক দূরে থেকেও স্বামীর কর্তব্য অনেকটাই পালন করে যাচ্ছে।
—ছাই করছে! মাঝখান থেকে আমার জীবনটা তোমরা দু’জনে মিলে নষ্ট করে দিলে। শ্বেতা মুখ গোমড়া করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর, ঘুমিয়ে পড়ার একটু আগে শ্বেতা অনুভব করল প্রমিলা ওর মাথায় পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শ্বেতার চোখে জল এসে গিয়েছিল কিন্তু ও চোখ মুছবার কোনও চেষ্টা করল না।
সে রাতে প্রমিলা মাঝরাতে উঠে স্নান করতে গেলেন না।
(চলবে)