পরের দিন কলেজ থেকে ফিরে শ্বেতা কাঁধের ব্যাগটা ঠকাস করে রাখল টেবিলের উপরে। –তোর ব্যাগে কী আছে রে? জিজ্ঞেস করলেন প্রমিলা। অত জোরে আওয়াজ হল।

—ওর মধ্যে আছে আমার আত্মরক্ষার অস্ত্র, শ্বেতা জানাল এক রহস্যময় হাসি হেসে।

যুগপৎ কৌতূহল এবং বিস্ময়ে চোখ কপালে তুললেন প্রমিলা। তার রোগা পটকা মেয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার জন্য ছোরা বা পিস্তল নিয়ে চলতে শুরু করেছে এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না প্রমিলা।

—দেখা দেখি কী অস্ত্র নিয়ে এলি তুই তোর ব্যাগে।

শ্বেতা ওর ব্যাগ খুলে একটা এক কিলো ওজনের গোল, মসৃণ, কালো পাথর বের করল। পাথরটা ওকে নিলয়ই জোগাড় করে দিয়েছিল। -ওমা! এত বড়ো পাথর ব্যাগে নিয়ে চলিস তুই! কিন্তু ওটা বের করে কাউকে মারতে হলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।

—ওটা বের করতে হবে কেন মা? এই দ্যাখো। শ্বেতা ব্যাগটা দু’হাতে ধরে ঘুরে দেখিয়ে দিল কীভাবে ও প্রতিপক্ষকে আঘাত হানবে। প্রমিলা মেয়ের বুদ্ধি দেখে অনেকদিন পর হেসে উঠলেন।

—তা অস্ত্রটা ভালোই জোগাড় করেছিস তুই কিন্তু ওটা কাজে লাগানো অত সহজ হবে না। বদমাশ ছেলেগুলো আজকাল পকেটে ছোরা পিস্তল রাখে। পেপারে প্রায়ই এ নিয়ে লেখালেখি হয়।

—তা রাখুক না, পকেট থেকে পিস্তল বের করতেও তো সময় লাগে। আমি তার আগেই ব্যাগটা ঘুরিয়ে মারব মুখের উপর… ঠিক এইভাবে। মাকে আশ্বস্ত করতেই শ্বেতা ফুল অ্যাটাকিং পশ্চারে গিয়ে দুই হাতে ব্যাগটা ঘুরিয়ে মারল ঘরের দেয়ালে। অনেকদিন আগে রং করা দেয়াল থেকে বড়ো এক চাকা পলস্তারা খসে পড়ল মেঝেতে।

—দেখলে তো কী স্পিডে অ্যাটাক করলাম আমি।

অবিশ্বাসের হাসি হেসে প্রমিলা বললেন, ‘দেখলাম৷’ শ্বেতার মনে হল ওর মা এখনও ওর উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না। পরের দিন শ্বেতা নিলয়কে সবকথা খুলে বলার পর ও বলল, “তোমার মাকে ডেমো না দিলে চলবে না। একদিন ওনাকে সঙ্গে করে বাসে চেপে কলেজে নিয়ে যাও। অ্যানুয়াল ডে বা ওইরকম কোনও ফাংশানে নিয়ে যাও ওনাকে আর রাস্তায় ডেমো দিয়ে দাও।”

—কী করে ডেমো দেব রাস্তায়? শ্বেতা বলল। যাকে তাকে পিটিয়ে জেলে যাব না কি আমি?

—কেন, তুমি যে বাসটায় কলেজে যাও সেই পাঁচশ চৌত্রিশ তো শুনেছি ইভটিজারস প্যারাডাইজ।

একসময় ছিল, এখন আর নেই। আমি কলেজে ঢুকবার আগেই আমাদের কলেজের কয়েকটা মেয়ে একসঙ্গে মিলে একটা ইভটিজারকে এমন পিটুনি দিয়েছিল যে ওকে তিনদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। তারপর ওকে জেলে পুরে দেওয়া হয়। বাজে টাইপের কোনও ছেলে বাসে উঠলে কন্ডাক্টরই এখন তাকে পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে বলে।

—ব্যাড লাক শ্বেতা, ডেমোটা দিতে পারলে তোমার মাকে পুরোপুরি লাইনে আনা যেত।

নিলয় হয়তো ঠিকই বলেছে। কেন-না শ্বেতা দেখল প্রমিলা আবার মাঝরাতে উঠে স্নান করতে শুরু করে দিয়েছেন। শ্বেতা যতই বোঝাবার চেষ্টা করে ও এখন পুরোপুরি নিজেকে সুরক্ষিত করে বাসে যাতায়াত করছে, রাস্তায় সে কোনও বিপদের মুখে পড়বে না— প্রমিলার চোখে সেই অবিশ্বাসের চাহনিটা শ্বেতাকে বিদ্ধ করেই যায়।

নিলয়ের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলে শ্বেতা শেষপর্যন্ত একদিন মাকে নিয়ে বাসে কলেজে যাবে ঠিক করে ফেলল। সন্ধ্যার পরে মেয়েকে কোনওমতেই বাড়ির বাইরে যেতে দেবেন না প্রমিলা, তাই ‘স্পোর্টস ডে’তেই ও মাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে তার সঙ্গে কলেজে আসতে রাজি করাল।

—কিন্তু আমি তো তোর মতো বাসে দাঁড়িয়ে যেতে পারব না, প্রমিলা বললেন মেয়েকে। একটা অটো নিলেই তো হয়।

—লেডিস সিটে তুমি জায়গা পেয়ে যাবে, তা ছাড়া বাসে কীভাবে আমি রোজ যাতায়াত করি সেটাও নিজের চোখে দেখে নেবে তুমি। দ্বারকা মোড় থেকে ওরা পাঁচশো চৌত্রিশ নম্বর বাসে উঠলে অল্প বয়স্ক একটি মেয়ে একটু সরে বসে লেডিজ সিটে প্রমিলাকে বসার জায়গা করে দিল। বাসে বেশ ভিড় থাকায় শ্বেতাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হল।

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...