রামকৃষ্ণপুরমের মধ্য দিয়ে যাবার সময় একটি ছেলে বাসে উঠে শ্বেতার ঠিক পাশ ঘেঁসে দাঁড়াল। প্রমিলা কড়া নজর রাখলেন ছেলেটির দিকে। লম্বা দোহারা চেহারার কুড়ি একুশ বছর বয়সি ছেলেটিকে দেখে ভদ্রঘরের বলেই মনে হল৷ গালে রেশমের মত নরম দাড়ি, চোখে চশমা, পিঠে ঝোলানো ব্যাগ, ঠিক শ্বেতার মতোই। হয়তো দক্ষিণ দিল্লির কোনও কলেজের ছাত্র হবে। ও নিশ্চয়ই শ্বেতাকে ইভটিজিং করবে না। কিন্তু সরোজিনী নগরে ঢোকবার মুখেই প্রমিলা লক্ষ্য করলেন ছেলেটা শ্বেতার সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা পাতাবার চেষ্টা করছে। ওর ঠোঁটে হবু প্রেমিকের চতুর হাসি, ওর কাঁধ ছুঁয়ে আছে শ্বেতার কাঁধ।

—শ্বেতা, সরে দাঁড়া, সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন প্রমিলা।

—তুমি চুপ করো মা, বাসের মধ্যে একটু ঘেঁসাঘেঁসি হয়েই থাকে, মাকে ধমকে দিল শ্বেতা। কিন্তু প্রমিলা কী করে চুপ করে থাকবেন ? ছেলেটা যে এবার কনুই দিয়ে শ্বেতার বুক ছোঁবার চেষ্টা করছে!

—শ্বেতা ও কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছে। চল আমরা বাস থেকে নেমে অটো ধরি।

—তুমি এত ভয় পেয়ো না মা, আমার সঙ্গে তো অস্ত্র আছে।

—তোর অস্ত্র চালাবার আগেই…

কিন্তু প্রমিলার কথা শেষ হবার আগেই শ্বেতা চেঁচিয়ে উঠল, ‘লুচ্চা, লাফাঙ্গা, বদমাশ, লেড়কি কা সাথ বদতামিজি করতে হো! তারপর পিঠের ব্যাগটা খুলে নিয়ে দুই হাতে ওটা ঘুরিয়ে সপাটে মারল ছেলেটার মাথায়।

—ওঃ মর গিয়া… মর গিয়া! ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল, তারপর দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কঁকাতে কঁকাতে সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। যাবার পথে কলেজের আরও দু’চারটি মেয়ে চড় চাপড় দিল ওর মুখে, মাথায়, গালে। কন্ডাক্টর বাস থামিয়ে ওকে গলা ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল বাস থেকে।

প্রমিলা অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর রোগা পটকা মেয়েটা কীভাবে একটা অসভ্য ছেলেকে জব্দ করল। নাঃ, দিনকাল সত্যিই অনেক পালটে গেছে। নিজের চোখেই তো দেখলেন প্রমিলা বাসের অন্য মেয়েরাও অসভ্য ছেলেটাকে বেশ কয়েকটা চড় চাপড় মেরে দিল। অনেক হয়েছে, চল এবার নেমে পড়ি আমরা, প্রমিলা বললেন সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে। এরপর পুলিশ থানা হলে মুশকিলে পড়বি তুই।

—ওসব কিচ্ছু হবে না মা। এটা তো একটা ছোট্ট ঘটনা। একটু বোসো, পরের স্টপেই নামতে হবে আমাদের।

সেদিন বাড়ি ফিরে প্রমিলা বললেন, ‘মনে হচ্ছে তোকে আমি একটু বেশিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম। দিল্লিতে মেয়েদের জন্য বাসজার্নি আগের থেকে অনেক ইজি আর সিকিওর হয়েছে। আমাদের সময় তো একতরফা ইভটিজিং হয়ে যেত আর কেউ প্রোটেস্ট করার সাহস পেত না। এমনকী কন্ডাক্টর ঝামেলার মধ্যে না জড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকত। তবে রোজ ওরকম ব্যাগ চালাস না তুই, মাথা ফাটিয়ে দিলে পুলিশ কেস হয়ে যাবে।’

—এটা আমার থার্ড অ্যাসল্ট ছিল মা, শ্বেতা বলল বীরাঙ্গণার ভঙ্গিমায় কোমরে হাত রেখে। আমি মাইল্ড স্ট্রোকই দিয়েছি। মাথায় ছোট একটা পিং পং বল উঠে এলেই আমার অ্যাকশন কমপ্লিট। প্র্যাক্টিস মেক্‌স আ উওম্যান পারফেক্ট, তুমি তো তাই আমাকে শিখিয়েছ তাই না মা?

প্রমিলা আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। সেদিন উনি আর মাঝরাতে উঠে মাথায় জল ঢাললেন না। মেয়ের সাহস নিজের চোখে দেখেই বোধ হয় ওঁর মন থেকে চোদ্দো বছর আগে লেগে যাওয়া শরীরের নোংরা পরিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা এতদিনে দূর হল।

পরের দিন কলেজের কাছেই একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে শ্বেতা খুব সন্তর্পণে নিলয়ের ব্যান্ডেজটা খুলে দেখল তিনটে স্টিচ লেগেছে ওর মাথায়।

—আই অ্যাম সো সরি, নিলয়। এই নাটকটা না করলেই হতো।

—ইটস ওকে বেবি, নিলয় বলল কাঁধ ঝাঁকিয়ে। কঠিন অসুখে কড়া ওষুধ চাই। তা ডেমোটা তুমি ভালোই দিয়েছ। তোমার কলেজের বন্ধুরাও ভালো ভাবে কো-অপারেট করেছে আমাদের সঙ্গে। অন্তত তিনটে থাপ্পড় আর একটা গাট্টা খেয়েছি আমি বাসের দরজায় পৌঁছোবার আগেই।

—ওদের আইস্ক্রিম খাইয়ে দিয়েছি আমি।

—গুড। এখন তোমার ডেমোটা কাজ করলেই সবদিক রক্ষা। তা তোমার মার মিডনাইট বাথ বন্ধ হয়েছে?

—হ্যাঁ, বলল শ্বেতা মিষ্টি হেসে। তারপর নিলয়ের মাথার ব্যান্ডেজটা ভালো ভাবে আটকে দিয়ে ওর গালে চুমু খেল শ্বেতা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...