ছেলের কথা শুনে মনোময়বাবু রাগে জ্বলে ওঠেন এবং ছেলেকে একটি চড় মারেন। সবটাই ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এর ফল ছিল অনভিপ্রেত। অখিলেশ একটা ছোটোখাটো ব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ব্যাপারটা রাগে গৃহত্যাগ অথবা পাওনাদারদের থেকে গা ঢাকা দেওয়ার মধ্যবর্তী কিছু একটা। মনোময়বাবু ছেলেকে জিজ্ঞেস করেও কোনও সদুত্তর পাননি। কিন্তু সেই থেকে তাঁর মনে এই ভয় যে, অখিলেশ কোনও এক মস্ত বিপদে পড়েছে এবং ওই পাথর তিনটিও মোটেই নিরাপদ নয়।

—বুঝলাম। কিন্তু খুন হওয়ার পর তো ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পুলিশের জিম্মায় চলে গেছে। এক্ষেত্রে তবে তোমাকে তলব করার কারণ? আমি জানতে চাইলাম।

—ইন্সপেক্টর মল্লিকের বক্তব্য অনুযায়ী মনোময়বাবু তাঁর টেবিলের দেরাজে একটি চিঠি লিখে রেখে গিয়েছেন এবং সেখানে স্পষ্ট বলা আছে তাঁর ওই তিনটি পাথর অথবা স্বয়ং তাঁর কিছু হয়ে গেলে তদন্তের দায়িত্বভার যেন কমলাক্ষ মজুমদার অর্থাৎ আমাকে দেওয়া হয়। অগত্যা…

এই পরিশ্রমের কোনও পারিশ্রমিক আদৌও কমলাক্ষ পাবে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু একজন মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করার জন্য সে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তা দেখে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও কয়েকগুন বেড়ে গেল।

গাড়ি এসে থামল একটি লোহার গরাদ দেওয়া বিশাল গেটের সামনে। মোরাম বিছানো রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে একটি দু’তলা বাড়ি। একটু সেকেলে, ফলে উল্লেখযোগ্য কোনও বৈশিষ্ট্য নেই বললেই চলে। নীচতলা জনশূন্য এবং নিশ্চুপ। গাড়িবারান্দা ধরে উত্তরমুখে কিছুটা এগোলেই উপরতলায় ওঠার সিঁড়ি। আমরা সেই পথে এগোনোই স্থির করলাম।

দোতালায় উঠে ডানহাতের প্রথম ঘরটি মনোময়বাবুর। ইন্সপেক্টর মল্লিক দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কমলাক্ষকে দেখে ব্যস্ত গলায় বললেন, ‘যাক ভালোই হয়েছে আপনারা এসে গেছেন। যা দেখার একটু তাড়াতাড়ি দেখে নিন। ফটোগ্রাফি হয়ে গেছে। বড়ি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে ঘর সিল করতে হবে।

ইন্সপেক্টর মল্লিকের কথা শুনে বোঝা গেল, এই খুনের ব্যপারে কমলাক্ষের মধ্যস্থতা তিনি খুব খুশি মনে মেনে নিতে পারেননি। সত্যি বলতে, আমার এই বন্ধুটির ক্রমবর্ধমান খ্যাতি যে অনেকেরই ঈর্ষার কারণ তা আমার খুব ভালো করেই জানা।

আমরা যে-ঘরটিতে প্রবেশ করলাম দৈর্ঘ্যে সেটি মাঝারি মাপের। আদ্যোপান্ত আসবাবে ঠাসা – আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, দেয়ালের উপর বই সাজানো দুটি শেল্ফ এবং দুটি ফ্রেম বাঁধানো অয়েল পেন্টিং। ঘরের পশ্চিম দেয়ালে একটি মাত্র জানলা। ঘরের মাঝ বরাবর খাটের উপর মনোময়বাবুর নিথর শরীরটি পড়ে আছে এবং সেই শরীর আগলে দাঁড়িয়ে এক উর্দি পরিহিত কনস্টেবল। আমার চোখ আটকে গেল সিলিং-এর দিকে চেয়ে থাকা মনোময়বাবুর বিস্ফোরিত চোখদুটির উপর। মুখের উপর থেকে দৃষ্টি গেল মৃতের উপর। সেখানে চেপে বসে আছে একটি সরু অথচ গভীর রক্তের দাগ। শরীরের আর কোথাও কোনও ক্ষতের চিহ্ন নেই। বিছানার চাদরের উপর মৃতের শেষ লড়াইয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। দৃশ্যটার সামগ্রিক প্রভাব এমনই যে আমার শরীর শিউরে উঠল।

—বিনয়, একবার এদিকে এসো।

কমলাক্ষের ডাকে যেন আমার সম্বিত ফিরল। ঘরের উত্তর দেয়াল ঘেঁষে আলমারি ও ড্রেসিং টেবিলের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত একটি লোহার সিন্দুক। কমলাক্ষ এখন সেটিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে চলেছে। আমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। সিন্দুকের তালা খোলা। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল কিছু কাগজপত্র বাদে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

(ক্রমশ)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...