আজ সকালে দেখতে এসেছি সালামন্ডার বে। আজকের দিনটা রেখেছি একটু রিল্যাক্স করার জন্য, কেন না বিকেলে পাহাড় চড়তে যাবার পরিকল্পনা রয়েছে। নেলসন বে থেকে গাড়িতে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে এই বে। ১৭৯১ সালে সালামন্ডার নামে প্রথম ব্রিটিশ জাহাজ এসে যখন এই উপমহাসাগরে নোঙর গাড়ে, সেই সময় থেকেই এর নাম হয় সালামন্ডার বে। সালামন্ডার বে পোর্ট স্টিফেন্স-এর সবচেয়ে বসতিপূর্ণ এলাকা।

প্রথমেই গেলাম ওয়ান্ডা বিচে। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল ভাষায় ওয়ান্ডা মানে বালিয়াড়ি। বিচের পাশেই সুদূর বিস্তৃত বালিয়াড়ি থেকেই হয়তো এরকম নামকরণ। দেখেই বোঝা গেল সাঁতারুদের মধ্যে এই বিচ খুবই জনপ্রিয়। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউ বাদ নেই, সবাই জলকেলি করতে ব্যস্ত। বিচের পাশেই পার্কে পিকনিকের জায়গা আছে। অস্ট্রেলিয়ায় যাকে বলা হয় বারবিকিউ।

বাড়ি থেকে খাবার এনে এখানে রান্না করার ব্যবস্থা আছে। সেখানেও বেশ লোকের ভিড়। অনেকেই রান্নায় ব্যস্ত। তারপর সবাই মিলে একসাথে পার্কের চেয়ারে বসে খাওয়া-দাওয়ার সাথে সাথে চলবে আড্ডা। আমরা বিচের কাছেই একটা রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ করে ওয়ান্ডা হেড-এর পথ ধরে বিচের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মাথার উপর সূর্যের তেজ কিন্তু সমুদ্রের ঠান্ডা হওয়া যেন সেটাকে অনেকটাই পুষিয়ে দিল।

সালামন্ডার বে থেকে ফেরার পথেই পড়ে পোর্ট স্টিফেন্স-এর বিখ্যাত মদের দোকান, Murray’s Brewery। এটা ঠিক আমাদের জানা মদের দোকানের মতো নয়। এখানে দোকানের ভেতরেই বিভিন্ন গন্ধ এবং স্বাদের মদ, বিয়ার— এসব বানানো হয়। টুরিস্টরা তাদের পছন্দ মতো পানীয় কিনে পিছনের বড়ো বাগানে গিয়ে বসে রিল্যাক্স করে, সাথে ড্রিংক্স নেয়। আমরা দু-গেলাস বিয়ার কিনে নিয়ে পিছনের বাগানে গিয়ে বসলাম। বাইরের ত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা, কিন্তু এখানের পার্কে গাছের ছায়ায় ঠান্ডা বিয়ারটা যেন অমৃত মনে হল। এরপর হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আবার তৈরি হলাম মাউন্ট টোমারির চূড়া থেকে সূর্যাস্ত দেখব বলে।

নেলসন বে থেকে গাড়িতে শোল বে খুবই কাছে, কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেলাম। পাহাড়ের নীচে গাড়ি পার্ক করে উপরের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এই পাহাড়ের উপরে চড়ার শখটা হয়তো আমার অপূর্ণই থেকে যাবে। হাতে শুধু এক বোতল জল আর পকেটে মোবাইল ফোনটা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগলাম। সামনেই দেখলাম বোর্ডে লেখা আছে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছোতে পঞ্চাশ মিনিট লাগবে। মন থেকে একটুও সায় পাচ্ছি না। পুরোটা পথ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে।

আমি এক পা এগোই, তো দু-পা পিছোই। আমার হ্যাজব্যান্ড এরই মধ্যে হেঁটে অনেক উপরে উঠে গেছে। আমি তখনও চিন্তা করছি কী করব— উঠব, কী উঠব না। হঠাৎ দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা তার দুটো বাচ্চাকে সাথে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসছে। ছোটো বাচ্চাটার বয়স বড়ো জোর তিন হবে।

আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাহস যোগানোর ভঙ্গিতে ভদ্রমহিলা বললেন, আমার তিন বছরের ছেলে উপর থেকে ঘুরে এল। চেষ্টা করুন, ঠিক পারবেন। এবার আর দেরি না করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। কিছুদূর উঠতেই দেখতে পেলাম পাহাড়ের বাঁকে মাঝে মাঝে বসার জায়গা আছে। সিঁড়িতে বসে একটু জিরিয়ে নেবার সময় মনে হল তার মানে আমি একা নই। পাহাড়ে চড়তে অনেকেরই অসুবিধে হয়। তাই সবার সুবিধার্থে এই ব্যবস্থা।

প্রায় পঞ্চাশ মিনিট পর শেষ পর্যন্ত মাউন্ট টোমারির চূড়ায় পৌঁছোলাম। যদিও অনেকেই কুড়ি মিনিটের মধ্যে চূড়ায় পৌঁছে গেছে। আমার অবশ্য তাতে একটুও দুঃখ নেই। পাহাড়ের উপর থেকে সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সন্ধ্যা প্রায় সাতটা মতো বাজে। এখনও সূর্য রয়েছে। গ্রীষ্মকালে অস্ট্রেলিয়াতে রাত আটটার পরেও আকাশে সূর্য দেখা যায়।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...