পাহাড়ের চূড়া থেকে পোর্ট স্টিফেন্স, নেলসন বে আর টোমারি ন্যাশনাল পার্ক দেখা যাচ্ছে। এবার মনে হল এত কষ্ট করে পাহাড়ে ওঠাটা সত্যিই সার্থক হয়েছে। দেখতে দেখতেই সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলতে শুরু করল। আর সাথে সাথে চারদিকে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। মনের ক্যামেরায় বন্দি করে নিয়ে এলাম এই মোহময়ী প্রকৃতির রূপ। এরপর আবার ফেরার পালা। পাহাড় থেকে নামার সময় কষ্ট অনেকটাই কম হল। সময়ও অনেকটাই কম লাগল।
এত উঁচু পাহাড়ে চড়ে বেশ কিছুটা ক্যালোরি বার্ন হয়েছে, তাই খিদেও পেয়েছে বেশ। সামনেই শোল বে-র খুব জনপ্রিয় থাই রেস্তোরাঁ, ‘মড থাই’-তে ডিনার করতে ঢুকলাম। নেলসন বে আর তার আশেপাশের জায়গাগুলো সি ফুডের জন্য বিখ্যাত। এইসব উপসাগর আর তার কাছেপিঠেই অনেক নদী আর হ্রদ থাকার জন্য এখানে অফুরন্ত মাছ এবং অন্যান্য সি ফুড পাওয়া যায়। অধিকাংশ রেস্তোরাঁর মেনুতে সি ফুড আর বিভিন্ন ধরনের মাছ থাকে। গ্রিলড চিংড়ি, বেকড বাড়ামুক্তি মাছ, সাথে স্টিমড ভেজিটেবল আর স্যালাড দিয়ে ডিনার করলাম। ফেরার পথে নেলসন বে-র জনপ্রিয় আইসক্রিম শপ থেকে আইসক্রিম খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। এক কথায়, দিনটা খুব ভালো কাটল।
পরদিন সকালে উঠে ঠিক করলাম, ‘আজকের দিনটা একটু অন্যরকম ভাবে কাটানো যাক৷’ কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়লাম৷ নেলসন বে জেটিতে গিয়ে খোঁজ করতেই জানতে পারলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখান থেকে একটা ফেরি রওনা দেবে টি গার্ডনের দিকে। টি গার্ডন নেলসন বে-র ঠিক উলটো দিকে একটা ছোটো শহর৷ নেলসন বে থেকে গাড়ি করে যাওয়া যায় আবার ফেরি করেও যাওয়া যায়। গাড়িতে গেলে অনেকটা পথ বেশি ঘুরতে হয়। ফেরিতে যেতে এক ঘন্টা লাগে। সমুদ্রের ঠান্ডা হওয়া আর চারদিকের মনোরম দৃশ্য এক ঘন্টার এই যাত্রা পথকে আরও মনোরম করে তোলে।
টিকিট কেটে উঠে বসলাম ফেরিতে। ফেরিতে সবার জন্য লাইফ জ্যাকেট আছে। প্রয়োজন হলে ব্যবহার করতে হবে। যাত্রা শুরু করলাম টি গার্ডনের দিকে। এই এক ঘন্টার ফেরি যাত্রা ছিল অতুলনীয়। নীল জল, সৈকতের মনোরম দৃশ্য, মাঝে মাঝে একটা দুটো করে ডলফিনের জলকেলি, সব মিলিয়ে সে এক বিরল দৃশ্য! কিন্তু তখনও জানি না টি গার্ডনে গিয়ে কী করব। ফেরিতেই কিছু টুরিস্ট-এর সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম প্রায় সবাই আজ আমার মতো হারাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। ফেরির চালককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম টি গার্ডনে একটা বড়ো হোটেল আর পাব আছে, অধিকাংশ টুরিস্ট সেখানে গিয়ে লাঞ্চ করে দু-ঘন্টা পরে এই ফেরিতেই আবার নেলসন বে ফিরে আসে।
‘এক যাত্রায় পৃথক ফল’ কেনই বা হবে? তাই আমরাও অন্য সব টুরিস্টদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব ঠিক করলাম। টি গার্ডন হোটেলে গিয়ে দেখলাম খাবার স্টলের সামনে বেশ লম্বা লাইন পড়েছে। ফিশ অ্যান্ড চিপস আর বিয়ার দিয়ে এ যাত্রায় লাঞ্চ করা গেল। যদিও মনটা পড়ে আছে ফেরির জন্য। আবার এক ঘন্টা সমুদ্রের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারব, এই ভেবেই আমার অপছন্দের চিপসগুলো কোনওরকমে গলাধঃকরণ করা গেল। হঠাৎ মনে হল জীবনে সবকিছু পরিকল্পনা করে করা যায় না। জীবনের অনেক প্রাপ্তি হয়তো অপ্রত্যাশিত অপরিকল্পিত ভাবেই এসে যায়। আমার আজকের ফেরি সফর ঠিক এরকমই একটা প্রাপ্তি।
টি গার্ডন থেকে ফিরে সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম অনেকেই বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। একটু উৎসাহবশতই কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিছু মাছ ধরেছেন কি না। উত্তর এল, ‘এখনও কিছু পাইনি।’
(ক্রমশ…)