আকাবাঁকা লাল মেঠো পথ, পথের দু’ধারে শাল-পিয়ালের ঘন জঙ্গল। বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দুপুর। কালো ছাতার কালো কাপড় ভেদ করে খরতাপ পুড়িয়ে দিচ্ছে গা। এ অসহনীয় গরম! আলগোছে আঁচলটা গায়ে টেনে নেয় দয়িতা। সঙ্গের যুবতিটি নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। যার অপেক্ষায় সে সকাল থেকে স্টেশনে বসে ছিল।

এগারোটা পাঁচের ট্রেন ফেল করায় দয়িতা চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে পরের ট্রেনের অপেক্ষায় ছিল। শেষমেশ সময়ের বারোটা বাজিয়ে বারোটা পাঁচের ট্রেনে মেয়েটিকে স্টেশনে পৌঁছে দেয় মানবাধিকার কর্মী রানুদি। বেলা বয়ে যাওয়ায় দয়িতা কোনও কথা বলে না। তাকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আস্তানায় পৌঁছানো যায় ততই মঙ্গল। দূর্বিষহ গরমে চাঁদি ফাটার উপক্রম! দ্রুত পা চালায় সে।

শাল-পিয়ালের জঙ্গল পেরিয়ে উন্মুক্ত প্রান্তরের একেবারে শেষ প্রান্তে সবুজে ঘেরা ইটের গাঁথনি ও টালির ছাউনি দেওয়া চার কামরার আস্তানাটিই হল দয়িতার মাথা উঁচু করে বাঁচার ঠিকানা।

পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট একটা নদী কমলিনী। এঁকেবেঁকে গিয়ে এই জঙ্গলের বুকে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সে। কোথায় শেষ হয়েছে কমলিনীর যাত্রা দয়িতার তা জানা নেই। যেমন তার জানা নেই এখানে আসা মেয়ের দলের যাত্রা কোথায় শেষ হবে ! নাকি অজানা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে তারা! আনমনে তাকিয়ে থাকে সে জানলার গরাদে ধরা এক ফালি আকাশটার দিকে। সম্বিৎ ফেরে “দিদি” ডাক শুনে। ঘাড় না ঘুরিয়ে জানতে চায়, ‘কী হল? কিছু কি বলবি?”

—ওকে কি এখনই নিয়ে আসব ?

—এখন? নিয়ে আয়…।

এখানে সে সকলের দিদি। যার কাছে মেয়েরা মনের ঘরের আগল খুলে দেয় অকপটে। যাকে ভরসা করা যায় নির্দ্বিধায়, যার কাছ থেকে বাঁচার মন্ত্র পাওয়া যায়— সে-ই দিদি।

দিনের আলো ফুরিয়ে এলে তার ঘরে নবাগত যুবতিকে নিয়ে আসে। মেয়েটির সম্পর্কে বিশেষ কিছু আগাম জানা হয়নি তার। মানবাধিকার কর্মীরা মেয়েটিকে উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গেই কোনওরকমে তার কাছে পৌঁছে দিয়ে যায়।

যাইহোক, মেয়েটি ঘরে ঢোকার পর সে গলা উঁচিয়ে বলে, “ও রে দরজাটা ভেজিয়ে দে।’ অতীতে ফেরার জন্য সামান্য আচ্ছাদন মাত্র !

মেয়েটি মরা মাছের চাহনিতে তাকিয়ে থাকে জানলার গরাদে জমাট বাঁধা সন্ধের আঁধারের দিকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে খানিক, তারপর ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও আমায়?’

কোনও উত্তর দেয় না সে। দয়িতা আর কোনও প্রশ্ন করে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে, তার হাতটা নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো চাপে ভরসার আশ্বাস দেয়— এখানে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, কেউ কোনও ক্ষতি করবে না। আর তোমার যখন কিছু বলতে ইচ্ছা করবে সোজা চলে আসবে আমার কাছে।

কঠিন বরফ গলে তরল হতে থাকে, এতদিনের শুষ্কপ্রায় পাথুরে নদীতে সহানুভূতির পরশে কলকল ধারা বইতে থাকে। দয়িতা জানে এ ধারাকে থামাতে নেই, বইতে দিতে হয়…। একসময় মেয়েটি নিজেকে সামলাতে না পেরে ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। দয়িতা বাধা দেয় না। কী জানি তার এতদিনের অভিজ্ঞতায় হয়তো বা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা! তাই সে উদ্বিগ্ন না হয়ে আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। কানে ভেসে আসে সুরমা, টুম্পা, সুহানি, শেফালিদের হাসি মশকরার কলকল শব্দ….

কাহিনিগুলো ভিন্ন হলেও চরিত্রগুলোর মধ্যে কোথাও মিল রয়েছে। একই কন্ঠমালাতে আরেক কাহিনির সংযোজন মাত্র। পরদিন সকালেই দিদির ঘরে নবাগত মেয়েটি হাজির।

মাত্র মাস তিনেক আগের ঘটনা। বছর আঠারোর ফুটফুটে যুবতি রেশমা সুলতানা। কলেজ করে টিউশন সেরে গাঁয়ের আলপথ ধরে ফিরছিল সে। সবেমাত্র সন্ধে পেরিয়েছিল। নাহ, বাড়ি ফেরা হয়নি তার। সকালে ধানক্ষেতে মেলে তার রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহ। তারপর সরকারি হাসপাতালের বিছানায় চলে মেয়েটির মৃত্যুর সঙ্গে যমে মানুষে টানাটানি। পুলিশ প্রশাসন, রাজনীতি, সমাজ পাড়া- গাঁ খানিক উত্তাল হয়ে উঠে। ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়ে রাজনীতির মেছুয়ারা। আর অপরাধী? তার সাজা?

সে সব প্রশ্ন না করাই শ্রেয়। অপরাধীদের তো মাস মাইনে দিয়ে পোষা হয়। তারা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের আশ্রিত। তাদের বাঁচানোর লোকের অভাব হয় না। তার থেকে অনেক সস্তা এইসব মেয়েদের প্রাণ। একেবারে মুড়ি মুড়কির মতো। দু-চারটি গরিব ঘরের প্রাণ অকালে চলে গেলে কীই বা এসে যায়! দু’চারদিন মানুষজন একটু আধটু হায় হায় করে। তারপর জনগণের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নতুন উত্তেজনা পেলে এসব ভুলে যায়। আর সরকারও ছোটো ঘটনা, সাজানো ঘটনা বলে ঘাড় থেকে বিষয়টিকে টুক করে নামিয়ে ফেলে। বেশি কিছু হলে অভাগার পরিবারকে উপঢৌকন দিয়ে মুখ বন্ধ করে দাও। ব্যস, ওখানেই মেয়েটির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয় আর কী!

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...