এতকিছুর পরেও রেশমা কিন্তু প্রাণে বেঁচে যায়। ও-ই যে বলে না মেয়েমানুষের জান কইমাছের প্রাণ! মরেও মরে না। আর এখানেই শুরু হয় নতুন কাহিনি।তবে মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। তার বাপ-মা-ও মনে মনে তেমনটাই চেয়েছিল। নাহলে এমন নষ্ট মেয়েকে কে আর ঘরে তোলে! এমনিতেই গরিব ঘরের মেয়েকে তারা কলেজে পড়ানোর সাহস দেখিয়েছে। আর তাতেই নাকি উপরওয়ালা খেপেছে! রেশমা প্রাণে বাঁচলেও সে তার শেষ সম্বল, বাপ-মায়ের আশ্রয় হারায়। এমন মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার সবচেয়ে আপনার জনেরা। সেই অর্ধমৃত মেয়েটি মানবাধিকার কর্মীর হাত ধরে পৌঁছে গেছে দয়িতার ঠিকানায়।
দয়িতা মেয়েটির যন্ত্রণাময় অতীতের কাহিনি শুনতে শুনতে কখন যেন এক ছুটে ঢুকে পড়ে যৌবনের সেই পরিচিত পথটায়। তার বয়স তখন কতই বা! এই বয়সে যেমন হয়, দয়িতার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রেমে পড়েছিল পাড়ার এক দাদার। পরিচিত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক এগোতে সময় নেয়নি। দ্রুত তা মন ছাড়িয়ে শরীরে পৌঁছোয়। সে তার সবকিছু দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। তার সোহাগ ধারণ করেছিল দেহে। ক্রমে খবর তার পরিবার থেকে পাড়াগাঁ ছাড়িয়ে রাষ্ট্র হতে সময় নেয়নি। তখন সে দৌড়ে গিয়েছিল তার আশ্রয়ের কাছে, চলো দূরে কোথাও চলে যাই দু’জনে মিলে….
কথা শেষ হয়নি তার। ছুটে আসে প্রত্যাখানের বাণ, তা কী করে সম্ভব! সে সব পরে ভাবা যাবে। এখন তুমি…!
এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে সে ফিরে আসে বাবা-মায়ের কাছে। কিন্তু সেখানেও যে কঠিন ঠাঁই, পেটের বীজটিকে শেষ করো। না হলে…!
কেমন করে শেষ করবে সে নিজের শরীরে আশ্রয় নেওয়া ভালোবাসাকে! প্রতিটি মুহূর্তে যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল সে। পরিবার সমাজের চোখ রাঙানি শাসানি মেনে নিতে শরীরে মনে শেষ হয়ে যাচ্ছিল কুমারী মা। শেষমেশ সে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেদিন। সে বেরিয়ে পড়েছিল মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য। কিন্তু একাকী যুবতি, তার উপর গর্ভবতী। কোথায় যাবে সে? কে আশ্রয় দেবে? সিদ্ধান্ত নেওয়া অতি সহজ কিন্তু তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া বড়োই কঠিন। ক্লান্ত বিদ্ধস্ত মেয়েটি শরীরের বোঝা টানতে টানতে নিকট আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব সকলের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছিল সেদিন। আশ্রয় জোটেনি কোথাও! এমন নষ্ট মেয়েকে সমাজ ঘরে তোলে না। শেষমেশ দয়িতা আশ্রয় নেয় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।
দিনের স্টেশন তবুও তো শাসন মানে। কিন্তু রাতের? সে তো বারো ভূতের আড্ডাখানা। সেখানে যুবতি শরীরের দিকে এগিয়ে আসে বহু হাত। কোন হাতকে সামাল দেবে সে? কোন হাতের থেকে নিজেকে বাঁচাবে? নিজেকে বাঁচানো বড়ো কঠিন ঠেকে, বাড়ি ফিরে যাই, সেই ভালো। কিন্তু…
পরমুহূর্তে মত বদলায়। থেকে যায়। এক পাগলি বুড়ির সঙ্গে ঠাঁই নেয় প্ল্যাটফর্মের এক কোণায়। রাত বাড়তে থাকে। ক্রমে স্টেশন নির্জন হতে থাকে। ধীরে ধীরে ভবঘুরেরা আশ্রয় খোঁজে স্টেশনের ইতিউতি। দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঝিমোচ্ছিল সে। হঠাৎ ঘুমের মাঝে সে আঁতকে ওঠে! অপরিচিত হাত শরীরে খেলা করছে। প্রাণপণ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু তাকে পেড়ে ফেলতে চায় আসুরিক শক্তি। পাগলি বুড়ি বুঝতে পেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুষ্কৃতির উপর। দয়িতা কোনওক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রাণপণ দৌড়োতে থাকে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে। সেখানে পৌঁছনোর আগেই সে পড়ে যায়! স্টেশনের আলো আঁধারিতে প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকে শরীরটা। রক্তের স্রোত বয়ে যায় শরীরের গভীর থেকে। প্ল্যাটফর্ম ভেসে যায় কুমারী মায়ের রক্তে।
সেই পাগলি বুড়িই হাঁউমাউ করতে করতে ডেকে আনে স্টেশন মাস্টারকে। দয়িতার যখন জ্ঞান ফেরে দেখে সে রেল হাসপাতালের বিছানায়। বাড়ির লোককে খবর দিতে চেয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সে জানিয়ে ছিল, ‘কেউ নেই আমার, অনাথ!” হাসপাতাল থেকে স্টেশন মাস্টারের উদ্যোগে তার ঠাঁই হয়েছিল একটি হোমে।
তারপর দীর্ঘ কুড়ি বছরের লড়াইয়ে তিল তিল করে সে নিজেকে গড়ে তুলেছে। আর তার সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচার এই ঠিকানা। যেখানে রেশমা, সুরমা, টুম্পা, শেফালীরা… মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। মৃতপ্রায় দেহগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার তারা প্রাণ খুলে হাসতে পারে, কাজের মাঝে বাঁচতে পারে। ও-ই যে ওরা হাতের কাজ করতে করতে আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল- হাহাহা, হিহিহি…। সেই হাসি আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।
দয়িতা ধীরে ধীরে জানলায় এসে দাঁড়ায়। শুক্ল পক্ষের চাঁদ তখন দূরের শাল পিয়ালের জঙ্গলের মাথার উপর। চাঁদের আলতো আলোয় চারিপাশে আলো-আঁধারির এক মায়াময় জগৎ। সে তাকিয়ে থাকে চাঁদটার দিকে, কত কলঙ্ক বুকে নিয়ে সেও রাতের আঁধার দূর করে!