শীতের মৌসুম ফিরে এসেছে!  ভারতের মতো গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলিতে আবহাওয়ার পরিবর্তনেও নানারকম শারীরিক সমস্যা হয়। আর এই সমস্যাগুলির মধ্যে হজমের সমস্যা অন্যতম। কিন্তু কীভাবে হজমের সমস্যা এড়াবেন শীতকালে? এই বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোকপাত করেছেন কলকাতার এএমআরআই হাসপাতালের অ্যাডভান্সড ল্যাপারোস্কোপি এবং কনসালট্যান্ট গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সার্জন ডা. সঞ্জয় মন্ডল।

হঠাৎ তাপমাত্রার হেরফের কখনও কখনও শরীরের বিপাকের সমস্যা তৈরি করে। আসলে ভালো খাবার মানেই তা খেতে মন চায় অথবা বলা যায়, বেশ কিছু খাবার আছে যা আমাদের লোভ তৈরি করে। কিন্তু সব খাবার কি সব সময় সকলের খাওয়া উচিত? চিকিৎসকদের মতে অবশ্যই ‘না’। কারণ, মুখোরোচক খাবার মানেই হল বেশি তেলমশলা যুক্ত খাবার। আর এই ধরনের খাবার যদি আমরা বেশি মাত্রায় খাই কিংবা খাওয়ার পর সঠিক শারীরিক পরিশ্রম না করি, তাহলে হজমের সমস্যা হবেই। এই ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, নিয়মিত খাবার হজম না হলে এবং এই হজমের সমস্যা যদি দীর্ঘ দিন চলে, তাহলে লিভারের স্থায়ী ক্ষতি হবেই। আর লিভারের ক্ষতি মানেই শরীরে বাসা বাঁধবে আরও নানারকম রোগব্যাধি। বিশেষকরে শীতকালে আমরা যদি আমাদের খাদ্যাভ্যাসের প্রতি যত্নবান না হই, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য গভীর সমস্যায় পড়তে পারে।

Health
Dr. Sanjoy Mandal

দেখা যায়, শীতকালে আমাদের খাওয়ার ইচ্ছে বেশি হয় এবং ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য হাঁটাচলাও কমে যায়। ফলে, শীতকালে বেশি হজমের সমস্যা হয়।  তাছাড়া, ধীরেধীরে দূষণও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শীতকালে পরিবেশ দূষণ আরও বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে, পর্যাপ্ত সূর্যালোকের অভাব এবং সূর্যালোকের পর্যাপ্ত এক্সপোজারের অভাবের ফলে আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি-এর সংশ্লেষণ হ্রাস পায়, যা শেষ পর্যন্ত হাড়কে দুর্বল করে তোলে। আর হাড় দুর্বল হলে পরিশ্রম করার ইচ্ছে কমে যায় এবং এর ফলে হজমের সমস্যা তৈরি হয়। ঠান্ডা আবহাওয়া, সূর্যালোকের এক্সপোজার-এর অভাব প্রভৃতি কারণে হজম ছাড়াও আমরা নানারকম শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হই।  ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে চা এবং কফি পানের ইচ্ছে বেড়ে যায় এবং এর ফলে পেট গরম হতে থাকে। এই বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদী হলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক।

প্রসঙ্গত আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, যে পরিমান ক্যালরি আমরা শরীরকে দিচ্ছি, তা যদি সঠিক পরিমাণে ক্ষয় না হয় পরিশ্রমের অভাবে, তাহলে ওজন বেড়ে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত ওজন শরীরের পক্ষে মোটেই যে ভালো নয়, তা আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি। আরেকটি পানীয় যা কিছু লোক ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেশি পান করার প্রবণতা রাখেন, তা হল অ্যালকোহল এবং এটি অতিরিক্ত গ্রহণ করলে শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদে নয়, দীর্ঘমেয়াদেও ক্ষতিকারক। অতিরিক্ত অ্যালকোহল স্বল্পমেয়াদে রিফ্লাক্স এসোফ্যাগাইটিস এবং গ্যাস্ট্রাইটিস এবং দীর্ঘমেয়াদে লিভারের সিরোসিস, হৃদরোগ, প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং স্থূলতার দিকে নিয়ে যায়।শীতের ঋতুতে আমাদের তরল বিশেষত জল কম পান করার প্রবণতা থাকে এবং এর ফলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে, যা কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষকরে যাদের কিডনিতে পাথর রয়েছে, তাদের আরও বেশি সাবধান হওয়া উচিত। মনে রাখবেন, ডিহাইড্রেশনের ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা এবং পাইলস ও ফিসারের সমস্যাও বেড়ে যায়। তাছাড়া, শীতকালও এমন একটি সময় যখন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই, আমাদের সঠিক যত্ন এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, লিভার আমাদের শরীরের একটি প্রধান অঙ্গ। আমাদের সুস্থ রাখার জন্য সবসময় কাজ করে চলেছে লিভার। তাই, লিভারের যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। অন্যথায়, যে-সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি লিভার করে চলেছে, সেগুলি সঠিক ভাবে হবে না এবং আমরা নানারকম শারীরিক সমস্যায় ভুগবো।

আসলে, আমরা যে-ধরনেরই খাবার খাই না কেন, তা মেটাবোলিজম-এ সাহায্য করে লিভার। তাই লিভার সংক্রান্ত কোনও সমস্যা হলে, খাবার ঠিক করে হজম হয় না। অ্যাসিডিটি, গ্যাস্ট্রাইটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য ও হজম সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।

আমরা যে-খাবার খাই, তার থেকে পাওয়া পুষ্টি শরীরে সঠিক ভাবে শোষণ ও জমা হতে সাহায্য করে লিভার। তাই লিভারের সমস্যা হলে এই ধরনের খাদ্য উপাদান যেমন বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেলস-এর ঘাটতিজনিত সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষত আয়রন, ফেরাটিন, ভিটামিন এ, ডি, ই, প্রভৃতির ঘাটতি দেখা যায় শরীরে। তাই, লিভার ঠিক না থাকলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া, লিভার শরীরের অতিরিক্ত টক্সিন বের করে ডি-টক্সিফিকেশন-এ সাহায্য করে। তাই লিভার ঠিক কাজ না করলে, এই টক্সিন শরীর থেকে ঠিক ভাবে বেরোতে পারবে না এবং বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে।

লিভার-এর যে-সমস্যায় এখন ভীষণ ভাবে ভুগছেন অসংখ্য মানুষ, তা হল—ফ্যাটি লিভার। ফ্যাটি লিভার-এর সমস্যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। কিন্তু যদি আমরা ফ্যাটি লিভার-কে প্রাথমিক স্টেজ-এ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে লিভার-এর বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। যেমন— লিভার ফাইব্রোসিস, লিভার সিরোসিস, এমনকী ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

ফ্যাটি লিভার-এর প্রাথমিক স্টেজ সাধারণ ভাবে উপসর্গহীন। তাই আমাদের সচেতন থাকতে হবে। ফ্যাটি লিভার-এর দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্টেজ থেকে যে-উপসর্গগুলি বোঝা যায়, তা হল–পেট বেশি বেড়ে যায় শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে, অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া, হাঁপিয়ে যাওয়া, পেটে ব্যথা, বমি, হালকা জন্ডিস, ঘনঘন সর্দি কাশি। ২য় স্টেজ থেকে ওষুধের প্রয়োজন হয়। সেইসঙ্গে, নিয়ন্ত্রণ করতে হয় খাওয়া-দাওয়া এবং নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ফ্যাটি লিভারকে সুস্থ রাখতে হয়। তাই, সতর্ক থাকুন এবং সঠিক মাত্রায় ভালো খাবার খান। সেইসঙ্গে, প্রতিদিন তিন থেকে চার লিটার জল পান করুন। আর শীতের আলস্য কাটিয়ে পরিশ্রমের মাধ্যমে বাড়তি ক্যালরি ক্ষয় করুন। এরজন্য নিয়মিত হাঁটাচলা এবং ব্যায়ামের প্রয়োজন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...