অর্পণ প্রশ্ন করতেই সন্তোষবাবুকে চমকে দিয়ে মেয়েটি অর্পণের বলা মুখের কথাটাই যেন জুড়ে দেয়। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। সন্তোষবাবু হতবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন! তিনি এক কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বলবেন ভেবে পান না। কথাটা উচ্চারণ করা মাত্র তাঁর শ্বাসরোধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর অর্পণ আর সন্তোষবাবু দু’জনেই দু’জনার মুখের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কারওর মুখে কোন কথা ছিল না। কিছুক্ষণের জন্যে দু’জনেই নির্বাক।
সন্তোষবাবু এক সময় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলেন— খুব আশ্চর্য ব্যাপার তো! একটু কী যেন চিন্তা করে তিনি অর্পণকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করেন— এরপর কী ঘটেছিল বলতে পারো?
অর্পণ সেই সময় অন্যমনস্ক হয়ে আপন মনে নিজের কথা ভাবছিল। তারপর সন্তোষবাবুর অপার কৌতূহল মেটানোর উদ্দেশ্যে তার জীবনে আগাম ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বিবৃত করছিল— আজকের দিনের মতো সেই দিনটিও ছিল শনিবার। শনিবারে আমি আমিষ আহার করি না। সেদিন বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রিতদের মধ্যে তিনজন আমিষ না-খাওয়ার ব্যাপারে আমাকে উপহাস করেছিলেন। খানা-পিনার ব্যাপারে আমার সেকেলের মতো আচার-বিচার আছে জেনে তাঁরা রীতিমতো বিস্মিত বোধ করে ধিক্কার দিয়েছিলেন।
সন্তোষবাবু উৎসুক হয়ে অর্পণের কথাগুলো শুনছিলেন। আর মনে মনে ভাবছিলেন— এই জন্যই কি শেকসপিয়র-সাহেব বলেছিলেন, পৃথিবীতে অনেক অজানা রহস্য গা ঢাকা দিয়ে আছে যা দর্শনশাস্ত্রের ব্যাখ্যার অতীত। দুনিয়ায় এর চেয়ে বড়ো আর কী আশ্চর্যের ঘটনা থাকতে পারে? অর্পণের কথা তিনি যতই শুনছিলেন ততই রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি যেন সিনেমা দেখছেন। পরের দৃশ্যটা দেখার জন্যে তাঁর মনের ভেতর অবদমিত উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছিল।
সন্তোষবাবু ভেতরে এগিয়ে যাওয়ার অবসরে হঠাৎ বলে ওঠেন— বয়স হল সত্তরের ঘরে। রাত্রিবেলায় আজকাল বড়ো একটা চোখে দেখি না। আমার আসাটা শুধুমাত্র নিয়মরক্ষার জন্যে। নইলে ছেলের বাপ আমায় গালাগাল দিতে ছাড়বে না। এক কালে অফিসে দু’জনে একসঙ্গে আমরা কাজ করেছি। সে আমার বন্ধু। সে যাই হোক, তোমায় আমি আগে থেকে বলে রাখছি আমায় একা ফেলে তুমি যেন কোথাও চলে যেও না। আমাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। পরক্ষণে একটু রসিকতা করে বললেন, অর্থাৎ হাতে তুলে আমাকে খাওয়াতে হবে না। খাবারগুলো আমার প্লেটে তুলে দিলেই হবে। কোনটা খাই না খাই, তা চিনতে পারব না। আজকের দিনে তুমি তো আবার আমিষ খাও না। তাই আমার প্লেটে তুলে দিতে তোমার কোন আপত্তি নেই তো? ছোঁয়া খাও তো? নাকি তাও খাও না? এই ব্যাপারে তোমার কোনও অসুবিধে থাকলে তাহলে আমি তোমায় জোর করব না।
অর্পণ তাঁকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলে— আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ডিশে খাবার তুলে দিয়ে হাত ধুয়ে নেব। তাছাড়া আজকের রাতটা আমি আপনার কাছাকাছিই থাকব। তারপর খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেলে এমনিতেই আমরা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাব। তখন কে কার? সব একাকার।
সন্তোষবাবুর কৌতূহলাদ্দীপক প্রশ্ন— আচ্ছা, সেদিন স্বপ্নে তুমি আর কী কী দেখেছিলে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
অর্পণ উত্তরে জানায়— ধারাবাহিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। একটু থেমে সে বলে তবে টুকরো দুই-একটা ছবি যেগুলো এখনও ধুলোর আস্তরণে ঢাকা না পড়ে মনের আঙ্গিনায় জীবন্ত হয়ে আছে সেগুলো ইতিমধ্যে সবই প্রায় বলা হয়ে গিয়েছে। নতুন করে আমার আর কিছু বলার অবশিষ্ট আছে কিনা ভেবে পাচ্ছি না!
(ক্রমশ…)