মরমি, আমার মাথাটা একটু টিপে দেবে? আজ অফিসে কাজের চাপ ছিল, একগাদা ফাইল দেখতে হয়েছে। এ বছরেই প্রমোশন হওয়ার কথা। একটু বেতাল হলেই সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর প্রমোশন বন্ধ হওয়া মানেই আমার সুখের ঘরে আগুন। কারণ টাকাই তো সমস্ত সুখের কারণ। টাকা না থাকলে জীবন বৃথা! এ পৃথিবী বিষময়।
জানো, প্রমোশন হলে আমার প্রায় পাঁচ হাজার টাকা মাইনে বেড়ে যাবে। প্রমোশনটা হলেই তোমাকে আমি একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেব, যা তোমার বহুদিনের শখ। বিয়ের পর তোমাকে আমি কোনও উপহার দিইনি। এমনকী ফুলশয্যার রাতে তোমাকে একটা সোনার আংটি উপহার দিতে পারিনি। সে জন্য তুমি আমাকে অনেক দিন খোঁটা দিয়েছ। নিজের এই অর্থনৈতিক অক্ষমতার জন্য মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। ভেবেছি যার একটা সোনার আংটি কিনে দেবার ক্ষমতা নেই তার বিয়ে করাটাই উচিত হয়নি।
এবার প্রমোশনটা হলেই তোমার মনের অনেকগুলো সাধ আমি মিটিয়ে দেব। আজ লোডশেডিং-এর জন্য ঘরের লাইটটাও গেছে। মোমবাতির আলোয় তোমার মুখটা যেন রাতের এক গোছা রজনীগন্ধা।
এখন ভীষণ ভালো লাগছে, তুমি মাথা টিপে দিলে আমার কোনও মানসিক বা দৈহিক যন্ত্রণা বলতে কিছু থাকে না। এই জানো, এখন মনে হচ্ছে তুমি আমার মা। আমার অসুখ করলে মা ঠিক তোমার মতোই সেবা করতেন। মা মারা যাওয়ার পর তুমিই তার বিকল্প হয়েছ। আচ্ছা তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন? শরীর খারাপ নয়তো?
তোমার বিয়ের দিনের কথা মনে আছে? আমার কিন্তু সব মনে আছে। আসলে ওই দিনটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন মনে থাকবে। তোমাকে কিন্তু আমার মা প্রথম থেকেই ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। কথায় বলে কুপুত্র যদিও হয় কুমাতা কখনও নয়। আমি মাকে সুখী করতে পারিনি কিন্তু মা আমাকে সুখী করেছেন। মা বুঝতে পেরেছিলেন তোমাকে পেলে আমার জীবন সুখের হবে। আমার মতো সুখী বোধহয় পৃথিবীতে কেউ নেই। কিংবা হয়তো আছে, আমার জানা নেই।
বিয়ের দিনে আমি হয়েছিলাম একদিন কা বাদশা। আমাকে নিয়েই তো উৎসব। দধিমঙ্গলের সময় আমি বুঝেছিলাম আমার নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল। শুনলে অবাক হবে, আমি কিন্তু সেদিন উপোস করে থাকতে পারিনি। দুপুরবেলা লুকিয়ে দোকানে গিয়ে কষা আলুর দম আর পাঁউরুটি খেয়েছিলাম। অবশ্য সে জন্য আমি মা কালীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম। জানি না তিনি আমায় ক্ষমা করেছেন কিনা। যখন বউদি আমাকে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজাচ্ছিল তখন তোমার কথাই শুধু বার বার ভাবছিলাম। আচ্ছা, তুমি যখন কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে লাল বেনারসী পরে বসেছিলে তখন তোমার কী মনে হয়েছিল? আহা লজ্জা কীসের, বলো না। কী বললে ? তখন তোমার ভয় করছিল? খুবই স্বাভাবিক। বিয়ের দিনে সব মেয়েরই ভয় করে। তারপর বিয়ের অনুষ্ঠান মিটে গেলেই তোমরা হয়ে যাও রণচণ্ডী। এই রণচণ্ডী বললাম বলে তুমি রাগ করলে ? মাইরি তোমাকে একটু রাগাবার জন্যই কথাটা বললাম। আসলে রাগলে তোমাকে খুবই সুন্দর দেখায়।
এখন যদিও লোডশেডিং, তবু অন্ধকারে তোমার রাগ রাগ মুখটা আমি মনের আলো জ্বেলে ঠিক দেখতে পাচ্ছি। আচ্ছা আর তোমাকে রণচণ্ডী বলব না। এই তোমার পা ধরছি, হল তো? কে বলছে, আমি তোমার পায়ে হাত দিলে তোমার পাপ হয়? ভক্ত প্রতিমার পায়ে হাত দিলে কি প্রতিমার পাপ হয়? তুমিই তো আমার প্রাণ-প্রতিমা। আমার প্রাণেশ্বরী। লোকের বিশ্বাস গঙ্গায় স্নান করলে যেমন সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়, ঠিক সেইরকম আমার বিশ্বাস তোমার পায়ে হাত দিলে আমার সব পাপ নিঃশেষ হয়ে যায়। আমার মনে হয়, গত জন্মে হয়তো এককণা পুণ্য সঞ্চয় করেছিলাম, আর সেই পুণ্যের ফলেই তোমাকে এ জীবনে স্ত্রী রূপে কাছে পেয়েছি। এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। এই সবুজ জর্জেট শাড়িটা আজও পরেছ দেখছি। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখতে গেছিলাম তখন এই শাড়িটা পরেই তো তুমি আমার সামনে এসে বসেছিলে। হাঁটু মুড়ে বসলেও তোমার আলতা পরা ফরসা পা দু’খানি কিন্তু আমার নজর এড়ায়নি। জলপাথর বসানো নাক ছাবিটায় তোমাকে বেশ মানিয়েছিল। এখনও মনে আছে তুমি উঠে চলে যাবার পরও আমি হ্যাংলার মতো বারবার পাশের ঘরটার দিকে তাকিয়েছিলাম। আর কারও জীবনে ঘটেছে কিনা জানি না, মেয়ে দেখতে গিয়ে মন দিয়ে ফেলা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে।
(চলবে)