জানো, যখন সাদা টেরিকটের পাঞ্জাবি পরে গলায় ফুলের মালা দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন নিজেকে দেখে মনে হয়েছিল আমি মানুষটা দেখতে খারাপ নই। যদিও আজন্ম রোগা বলে আমার একটা দুঃখ আছে। কিন্তু যাই বলো বাপু আমার চোখ নাক মুখ মোটেই খারাপ নয়। এই, তুমি হাসছ নিজেকে সুন্দর বলছি বলে? নিজেকে সুন্দর সবাই ভাবে। যে, কুৎসিত কদাকার চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছে সেও নিজেকে সুন্দর ভাবে।
জানো, রোগা চেহারা নিয়েও আমি দুটো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছিলাম। যদিও ওরা কেউ আমায় ভালোবাসেনি। শুধুই দুঃখ দিয়েছে। আমার সঙ্গে ওরা ভালোবাসার খেলা খেলেছে। দশ বছর আগে আমি ভীষণ বোকা ছিলাম। তখন পাড়ার কোনও মেয়ে কাছে এসে একটু হেসে কথা বললেই ভাবতাম, বুঝি সে আমায় ভীষণ ভালোবাসে। আমি পাগলের মতো একটু ভালোবাসা পাবার জন্য ছুটে গেছি। পরক্ষণেই সহস্র দুঃখ নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে। ভালোবাসার পেছনে ছুটে যখন আমি পরিশ্রান্ত হয়েছি তখনই বুঝতে পেরেছি ওটা ভালোবাসা নয়, মরীচিকা।
যাক, যা বলছিলাম। আমাদের নিয়ম, বিয়ে করতে যাবার আগে মা-বাবা ও গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে হয়। মা আমার মাথায় দুর্বা দিয়ে যখন আশীর্বাদ করছিলেন, তখন আমি তাঁর চোখে জল দেখেছিলাম। মার চোখে জল দেখে সেদিন মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল। আচ্ছা, ছেলেরা বিয়ে করতে গেলে সব মায়েরাই কি কাঁদে? মনে হয়, মা ভাবছিলেন আমি পর হয়ে গেলাম।
তোমার মামা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। আমি যখন বরের সাজে গাড়িতে গিয়ে বসলাম তখন শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে পৃথিবী তোলপাড়। তিন বন্ধু আর ছোটো বোন অপুর বর আমার সঙ্গে ছিল। ঠিক সাড়ে ছটায় আমাদের গাড়ি ছাড়ল। উঃ সে কী আনন্দ। বালি ব্রিজ পার হয়ে বিটি রোডে আসতেই গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। আমরা সবাই মনমরা হয়ে গেছিলাম। অবশ্য সেদিন রাত একটা পর্যন্ত বিয়ের লগ্ন ছিল।
আমার বন্ধুরা গাড়ি থেকে নেমে চায়ের সন্ধানে গেল। বাইরে তখন বেশ ঠান্ডা পড়েছে। চিত্তবাবু আর ড্রাইভার বনেট তুলে গাড়ি ঠিক করতে লেগে গেছেন। একটু পর শম্ভু আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এল। আমার হাতে চায়ের কাপটা ঠকঠক করে কাঁপছিল। বিয়ের সময় যত এগিয়ে আসছিল আমার টেনশন তত বাড়ছিল। চিত্তবাবু ড্রাইভারের সিটে বসলেন। ওঁর হাতে যেন জাদু ছিল। গাড়িটাকে তিনি পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতোই ছুটিয়ে নিয়ে চললেন। তোমাদের বাড়ির সামনে যখন আমাদের গাড়ি পৌঁছোল, তখন অসংখ্য লোক ছুটে এল আমাকে দেখার জন্য। বিশ্বাস করো, আমার সে সময় ভয় করছিল। আবার ভালোও লাগছিল। আমার মনে হয়েছিল সেদিন আমি পৃথিবীর সম্রাট। তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এসে যখন আমাকে সদর ঘরে নিয়ে বসালেন তখন আনন্দে আমার চোখে জল এসেছিল। এত যত্ন এত আদর আমি আগে কখনও পাইনি।
বরযাত্রীরা রিজার্ভ বাসে আমার আগেই এসেছিল। রাত এগারোটায় ওরা খেতে চলে গেল। কথা ছিল বিয়ে সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বরযাত্রীরা কেউ যাবে না। ওরা কথা রেখেছিল।
আমি যখন লাল সাটিনের চাদর বিছানো বিছানায় বসে ভেলভেটের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে নিজেকে পৃথিবীর সম্রাট ভাবছি, ঠিক তখনই একটি সুন্দর মেয়ে এসে আমাকে একটা গোলাপফুল দিয়ে বলল, “জামাইবাবু এটা আমার উপহার।’
আমি ফুলটা নিয়ে বলেছিলাম, ‘ধন্যবাদ।’
লাল গোলাপের সুগন্ধে আমার বুকের ভেতর জমে থাকা নীল দুঃখগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। তখন ভুলেই গেছিলাম আমি দীপারুণ মিত্র বেসরকারি অফিসের বেতনভুক কর্মচারী।
মরমি, আমার কথাগুলো শুনতে তোমার ভালো লাগছে? তুমি বিরক্তবোধ করছ না তো? বলতে ভুলেই গেছি তোমার জন্য আজ আমি একটা পিওর সিল্ক শাড়ি কিনে এনেছি। শাড়ির প্যাকেটটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখেছি। রং-টা সবুজ। তোমার তো সবুজ রং ভীষণ ভালো লাগে। এই শাড়িটা পরে এসো না। দেখি তোমাকে কেমন মানায়। ওহো, এখন তো লোডশেডিং। আলো এলে শাড়িটা পরবে কিন্তু। আচ্ছা কত দাম নিয়েছে বলো তো? কি, একহাজার টাকা? তোমার তাহলে কোনও আইডিয়া নেই। ওই শাড়িটার দাম তিনহাজার আটশো টাকা। আলো জ্বললে তোমাকে আমি ক্যাশমেমো দেখাব। তাহালে বিশ্বাস হবে তো?
এই জানো, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন বলে অফিসের বন্ধুদের মাংসের চপ খাইয়েছি। ওরা ভীষণ খুশি হয়েছে। তোমার জন্যও এনেছি। তোমার জন্য রজনীগন্ধা ফুল এনেছি। রজনীগন্ধা তো তোমার প্রিয় ফুল। আর একটু রাত হোক ফুলদানিতে ফুলগুলো রেখে দিও কেমন?