স্যার চার্লি চ্যাপলিন সেজেছিল সেই সন্ধ্যায় প্রবাল। নকল বাটার ফ্লাই গোঁফ। ঢোলা শার্ট, ঢোলা প্যান্ট, থ্যাবড়া জুতো। হাতে বাঁকা মজবুত স্টিক একটা। চারিদিকে সুস্থ, সবল মানুষেরা কেউ কিছু বলছে না। আজ প্রমাণ করবে সে, সারা শরীর মানুষের অবজ্ঞা মাখা কত শক্তি এই বামন শরীরে। স্বাভাবিক, ভয়হীন মস্তিষ্ক। সবাইকে হতভম্ব করে, বিশেষত ওই মাতাল যুবকটিকে কোনও প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওই বাঁকা লাঠিটি সজোরে দু’বার পায়ে এবং পিঠে ঘুরিয়ে মারে। ওড়নাটা মুঠো থেকে খসে হাওয়ায় উড়ে যায় গাড়ি পার্কিং জোনের দিকে। বেসামাল হয়ে যুবকটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। সবাই ছুটে এসে তাকে মাটি থেকে তুলে ধরে। বিপদের গন্ধ পেয়ে সঙ্গের অন্য যুবকটি ততক্ষণে মোটর সাইকেলে উঠে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। টানতে টানতে আহত সঙ্গীটিকে পেছনে বসিয়ে অশ্রাব্য গালাগাল এবং বদলা নেওয়ার কথা বলতে বলতে ওরা চলে যেতেই মাটি থেকে ওড়নাটা কুড়িয়ে ঝিমলির দিকে তা বাড়িয়ে ধরেছিল প্রবাল।
—দাঁড়াবেন না, চলে যান বাড়ি। তার সেই সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্যই ঝিমলি কি তাকে বকশিশ দিতে চায় আজ?
ঘড়িতে ন’টা বাজতেই রোজকার মতো অর্কেস্ট্রার শব্দ থেমে যায়। চল্লিশ মিনিট বাদেই ঝিমলি বাইরে বেরিয়ে আসবে। প্রবাল সরে যেতে চায় দরজার পাশ থেকে। কিন্তু একে একে সব সম্মানীয় খদ্দেররা বেরিয়ে আসবে। সাথে ছোটো মালিকও হয়তো বেরিয়ে আসবে। দম বন্ধ করে তাই একে একে সবাইকে ‘বাও’ করতে থাকে ‘মহারাজ’ ওরফে প্রবাল।
সব খদ্দের প্রায় চলে গেছে, এমন সময় সুইংডোর ঠেলে বেরিয়ে আসে ঝিমলি। প্রবাল গেটের কাছ থেকে সরে মালিক পক্ষের নিজস্ব গাড়ি রাখার শেডে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিমলিও এগিয়ে যায় সেদিকে।
—প্রবালদা! আজ দোল পূর্ণিমা— বলেই নীচু হয়ে একমুঠো আবির প্রবালের পায়ে দিয়েই টিপ করে প্রণামটা সেরে ফেলে। সাইড ব্যাগের মধ্যে থেকে একটানে বেরিয়ে আসা ঝুরঝুরি নীল রঙের রাংতায় মোড়া ভারি সুন্দর একটা প্যাকেট প্রবালের হাতে দেয়। একই সাথে কথা বলে সে, আমাকে দেখে সরে যাচ্ছিলেন কেন? আমি খারাপ মেয়ে। হোটেলে নাচি, তাই? আমার জন্য আপনাকে সেদিন থানায় মেরেছে, আটকে রেখেছিল। কিন্তু এই খারাপ মেয়েটা কোনওদিন আপনাকে ভুলবে না, দাদা! কবে থেকে আমি অপেক্ষা করে আছি এই দিনটার জন্য, জানেন? কণ্ঠস্বর ভিজে আসে ঝিমলির।
এইবার মাথা নীচু করে প্রবালের সামনে চুপ করে দাঁড়ায়। এখন কী করতে হয় প্রবাল জানে না। তাকে কোনওদিন কেউ আবির দেয়নি। এ দুর্লভ মূহুর্তে কি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতে হয় বোনকে!
সিনেমায় দেখেছে নায়ক দাদা বোনের হাতে একগোছা টাকা তুলে দেয়। কিন্তু তার পকেট তো একদম ফাঁকা। কোনও টিপসও আজ পায়নি সে। কিছু একটা ভেবে ওঠার আগেই আবারও রুমালে চোখ মুছে ঠোঁট টিপে হেসে ঘুরে দাঁড়ায় ঝিমলি— ‘চলি, আবার কালকে’।
সামনের বাঁক পেরিয়ে ওদের মোবাইক চলে যেতেই আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় প্রবাল। মাথার ওপরে থালার মতো মস্ত পূর্ণিমার চাঁদ। না আজ সে গাঁটুল নয়। দৈত্যের মতো বিশাল এক শরীর আজ তার। মাথার ওপর দীর্ঘ দু’বাহু তুলে ওই আকাশের দিকে টানটান মেলে ধরে প্রবাল গুহ। পরনে মহারাজ-এর ঝলমলে রাজকীয় পোশাক। ডান হাতের তালুতে জীবনের সব গ্লানি ছাপিয়ে সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছে একটা নীল প্যাকেট।
(সমাপ্ত)