শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম পৃথিবীর আলো দেখা। তারপর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা। হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা, মনে হাজারো প্রশ্নের আনাগোনা। জলের রং কেন সাদা, গাছের পাতা কেন সবুজ, আকাশ কেন নীল, এটা-ওটা-সেটা— যার উত্তর দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় অভিভাবকদের। আর এর জন্য ধৈর্যও লাগে। বর্তমানে ব্যস্ত জীবনশৈলীর কারণে, কখনও কখনও অভিভাবকদের পক্ষে সেটা সম্ভবও হয় না। তাই জিজ্ঞাসু শিশুমনের বিকাশে প্রি-স্কুল অত্যন্ত জরুরি। গতানুগতিক শিক্ষার আগে প্রি-স্কুল হল শিশুদের জন্য একটু অন্য ধারার স্কুল।
প্রি-স্কুলে কখন পাঠাবেন:
দুই থেকে আড়াই বছর বয়সই হল প্রি-স্কুলে পাঠানোর জন্য উপযুক্ত সময়। ২৫-৩০ বছর আগেও ছবিটা অন্যরকম ছিল। পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হতো বাচ্চারা। স্কুলের উঁচু শ্রেণির ছাত্রদের দেখে ঘাবড়ে যেত অনেক বাচ্চাই। যার প্রভাব পড়ত সবে স্কুলে পা রাখা শিশুদের উপর। আর এই সমস্যার সমাধান হল, প্রি-স্কুল।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ২-৬ বছর বয়সটা হল শিশুমনের বিকাশের উপযুক্ত সময়, যখন হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে তাদের মনে। যার সময়োচিত ও সঠিক উত্তর বিকশিত করে তাদের। পরিবারের ছোট্ট ও ব্যস্ত পরিসরে যা সম্ভব হয় না।
কীভাবে বাছবেন:
বাচ্চাদের Pre-School নির্বাচনের সময় নিম্নলিখিত কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত—
শিশুদের নিরাপত্তা: স্কুলের পরিকাঠামোতে শিশুরা কতটা নিরাপদ, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কী কী ব্যবস্থা রয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব: এই দূরত্ব ৩ কিলোমিটারের বেশি যেন না হয়। ৮-১০ কিলোমিটার কিংবা তার বেশি যাতায়াত করতে হলে ছোটোদের পক্ষে তার ধকল সামলানো মুশকিল। আর স্কুল যাতায়াতেও অনেকখানি সময় চলে যাবে। একই সঙ্গে ক্লান্ত হয়ে পড়বে আপনার বাচ্চা।
স্কুল ম্যানেজমেন্ট: প্লে-স্কুল চালানোর ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ কতটা অভিজ্ঞ, ভর্তির আগে তা অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত। ছোটোদের সঙ্গে একদম ছোটোদের মতোই আচরণ করতে হবে। যার জন্য অনেক ধৈর্য দরকার। অনভিজ্ঞের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। সেই জন্য এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রাউন্ড ফ্লোরেই স্কুল: প্লে-স্কুল গ্রাউন্ড ফ্লোরে হওয়া উচিত। খোলা জায়গা থাকাটা জরুরি। বাচ্চারা খেলতে ভালোবাসে। তার জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা আছে কিনা দেখে নেবেন। যেমন ডল হাউস, জু, স্টেজ ইত্যাদি। স্কুলের লন এরিয়া, খেলাধুলোর জন্য ইনডোর ফেসিলিটি আপনার বাচ্চার জন্য উপযুক্ত কিনা— সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিন। স্কুল সংকীর্ণ হলে বাচ্চাদের বিকাশ ঠিকমতো ঘটবে না। তাই Pre-School নির্বাচনের আগে এই বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রাক্তন ছাত্রদের অভিজ্ঞতা: খুব ভালো হয় যদি প্লে-স্কুল নির্বাচন করার আগে প্রাক্তন ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারলে। তাদের অভিভাবকদের থেকে জেনে নিন সংশ্লিষ্ট স্কুল সম্পর্কে। এ ব্যাপারে প্রাক্তন ছাত্র ও তাদের অভিভাবকদের অভিজ্ঞতা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
প্লে-স্কুল বা Pre-School প্রয়োজন কেন:
বর্তমানে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি এবং অভিভাবকদের ব্যস্ততা এর অন্যতম কারণ। পরিবারের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ পায় না শিশুরা। যে- শূন্যতা অনেকটাই পূরণ করে প্রি-স্কুল। সমবয়সি অনেক বাচ্চা থাকার ফলে, খেলার সঙ্গী পায় তারা। আর খেলতে খেলতেই শিখে নেয় অনেক কিছু। অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়ে যায় এভাবেই। শিক্ষকরাও থাকেন গাইড করার জন্য। বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে অনেক দ্রুত এবং সহজে ইন্টার্যাক্ট করতে পারে। এতে শিশুদের মানসিক বিকাশ দ্রুত আর সহজে হয়। বড়োদের সঙ্গে থেকে বা বড়োদের পরিবেশে যা হয় না।
প্রি-স্কুলের বড়ো প্লাস পয়েন্ট হল বাচ্চাদের একসঙ্গে মিলেমিশে থাকা। এর ফলে শিশুরা ফ্রেন্ডলি পরিবেশ পেয়ে থাকে। শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিস করানো হয়, যা ছোটোদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। অল্প বয়সেই পরিণত করে তোলে শিশুদের। প্লে-স্কুলের পরিবেশ, ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে দেওয়া সম্ভব নয় অভিভাবকদের পক্ষে। আর প্লে-স্কুল থেকে যখন শিশুরা ফর্মাল স্কুলে পা রাখে, অভিভাবকদের সমস্যায় পড়তে হয় না। এমনকী খুব অল্প বয়সে স্কুলের সঙ্গে পরিচিতির ফলে, বাচ্চারাও সহজেই মানিয়ে নিতে পারে ফর্মাল স্কুলে।
অভিভাবকদের সুবিধা:
শহরকেন্দ্রিক জীবনে বাবা-মা উভয়েই কাজে ব্যস্ত থাকে। তবে শুধু শহর নয়, আজকাল শহরতলি এলাকাতেও এই ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। তাই দু’-আড়াই বছরের বাচ্চাকে প্রি-স্কুলে পাঠিয়ে অভিভাবকরা অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারে।
বাচ্চারা যাতে নিজেরাই খেলার ছলে শিখে নিতে পারে, সেই ধরনের অ্যাকটিভিটিস রাখা হয়। তাছাড়া স্কুলের অন্য বাচ্চাদের দেখাদেখি শেখার, জানার আগ্রহ তৈরি হয়। বাড়িতে খাওয়া নিয়ে সমস্যা হলেও, স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে সহজেই খেয়ে নেয় বাচ্চারা। আসলে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলতে, থাকতে, কথা বলতে ভালোবাসে শিশুরা। এই স্কুলে ব্যবহারিক দিকগুলিও শেখানো হয়। বড়োদের সঙ্গে কী করে কথা বলবে, কীভাবে তাদের সম্মান করবে এবং আরও অন্যান্য শিষ্টাচার। যে-শিক্ষা পরবর্তী জীবনে সঠিক দিশা দেখায় শিশুদের।