যদি কেউ আপনাকে বলে যে আপনি অনলাইনে যা কিছু ফিড করছেন তা আপনি নিজের ইচ্ছায় অনেক বেশি এআই প্রযুক্তির অ্যালগরিদিমিক পদ্ধতি ফলো করছেন, তাহলে আপনি কি অবাক হবেন না? ডিজিটালের প্রভাব মানুষের জীবনে খারাপ ভাবে ঢুকে পড়েছে, এটা অনেকটা ব্যক্তিগত জীবনকে হ্যাকিংয়ের মতো।
ডিজিটাল দুনিয়া তরুণদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি সকালে উঠেই আধা ঘুমের মধ্যে আপনার নিজের ফোন চেক করেন। তথ্যের জন্য সংবাদপত্রের পরিবর্তে, অসত্য তথ্য-সহ হোয়াটসঅ্যাপ দেখেন এবং ফরোয়ার্ড করেন। ইমেল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ফিডের মাধ্যমে চিন্তা না করেই স্ক্রোল করা শুরু করেন।
এগুলো দেখতে দেখতে, আপনি ক্লিক এবং ট্যাপগুলির আকর্ষণে এমন আটকা পড়েন, যা আপনার মূল্যবান সময় এবং মানসিক শক্তি নষ্ট করতে শুরু করে। আপনি যে তথ্যটি পড়ছেন তা সঠিক কিনা তা না জেনেই আপনি অ্যাপ্লিকেশন এবং প্ল্যাটফর্মগুলির এমন একটি জালে আটকা পড়ে যান যে, আপনি কেবলমাত্র একজন গ্রাহক হয়ে ওঠেন যাকে কিনা যে-কোনও ভাবে পণ্য গছিয়ে দিতে পারলেই হয়।
এটাই ডিজিটাল দুনিয়ার বিশেষত্ব যে আমরা প্রতিদিন যে অ্যাপস এবং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করি, সেগুলো যত বেশি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ততই তারা এই ভোগ্যপণ্য ও পণ্যের খেলায় সফল হয়। কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন যে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদম পদ্ধতি ব্যবহার করেই সফল হয়েছে।
অ্যালগরিদম পদ্ধতি কি
কম্পিউটার বিজ্ঞানের মতে অ্যালগরিদম হচ্ছে এক ধরনের প্রোগ্রামিং প্রক্রিয়া, যার উপর ভিত্তি করে অনলাইন ভোক্তার বিশ্লেষণ করা হয় এবং তার প্রতিটি কার্যকলাপ নির্ভুলভাবে অনুমান করা হয়। এই কৌশলটি প্রায় প্রতিটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
আপনি নিশ্চয়ই এটাও লক্ষ্য করেছেন যে, আপনি যদি কোন সাইটে কোনও প্রোডাক্ট দেখেন তাহলে সেই প্রোডাক্টের রিকমেন্ডেশন আপনার কাছে প্রতিনিয়ত প্রতীয়মান হতে থাকে। এটি আপনার স্ক্রিনে ক্রমাগত ফ্ল্যাশ করে, আসলে, ইন্টারনেট Algorithm এটিই করে।
এই অ্যালগরিদমটি আপনার প্রতিটি কনটেন্টের (অডিও, ভিডিও, আর্টিকেল বা যে-কোনও পণ্য ইত্যাদি) কি-ওয়ার্ড, ট্যাগ, টপিক যা আপনি শুনেছেন, দেখেছেন, পড়েছেন বা ওপেন করেছেন এবং রিঅ্যালগরিমেন্ট দিয়েছেন সেগুলো ক্যাচ করে। তার উপর ভিত্তি করে, এটি ক্রমাগত আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ বুঝে আপনাকে স্ক্রিনে শো করতে থাকে।
ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে হলে আপনার পেজে যে সাজেশনগুলো দেখেন সেগুলো আপনার তৈরি করা বাকি বন্ধুদের সাথে সরাসরি কোথাও কানেক্টেড থাকে। এই অ্যালগরিদমটিও কাজ করে। তিনি আপনার ফ্রেন্ড সার্কেল চিহ্নিত করেন, আপনার পছন্দের বিচার করেন। আপনি কোন ভাষায় আছেন, কোন এলাকা থেকে, কোন লিঙ্গের বন্ধুদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন তাও তিনি দেখেন। ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারও এই কাজটি করে থাকে।
ব্যক্তিগত জীবন হ্যাক
Algorithm খুবই শক্তিশালী একটি টুল। এই টুলটি ডিজিটাল ভোক্তাদের ব্যক্তিগত জীবন হ্যাক করছে, তাদের প্রভাবিত করে। তাদের পছন্দ-অপছন্দের তথ্য একত্রিত করছে অর্থাৎ, এক অর্থে ভোক্তা তার পছন্দের কনটেন্ট দেখছে না, বরং তাকে সেই একই কনটেন্ট দেখানো হচ্ছে যা অ্যালগরিদম নিজের স্বার্থে তাকে বোঝাচ্ছে।
অ্যালগরিদম আপনাকে এমন একটি কাল্পনিক জগতে নিয়ে যায় যেখানে সবকিছু একই রকম চলছে বলে মনে হয়। যেমন ধরুন একটি মেয়ে নিজের জন্য শপিং সাইট ‘মিন্ত্রা’-তে পোশাকের নতুন ট্রেন্ড খুঁজছে। এ জন্য ‘অ্যামাজন’ ও ‘মিশো’ শপিং সাইটও সে দেখছে। যদি তার কাছে টাকা না থাকে তবে সে এই কেনার পরিকল্পনা বাদ দেয়। এখন যখন সে আবার অনলাইনে আসে তার মোবাইলের পর্দায় তার পছন্দের কুর্তির ছবি জ্বলজ্বল করে ফুটে ওঠে।
এটি তার কুর্তির পছন্দকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিলেও তাকে কিছু কিনতে বাধ্য করা হয়। দ্বিতীয়ত, সে যে হারে কুর্তির খোঁজ করছে হয়তো তাতে করে তার আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখতে পাওয়ার সম্ভবনা কমতে থাকে। অ্যালগরিদম তার কুর্তির পছন্দকেই আঁকড়ে ধরে ওকে ক্রমাগত দেখাতে থাকে।
প্রায়শই যখন আমরা ডিজিটাল এক্সপ্লোরেশন সম্পর্কে কথা বলি, আমরা অনুমান করি যে এটি বিস্তৃত তথ্য সরবরাহ করছে, তথ্যের একটি যৌথ উৎস এটি। কিন্তু আসলেই কি সঠিক তথ্য দিচ্ছে নাকি আমাদের ভুল তথ্য দিচ্ছে?
তদন্ত করা কঠিন কিছু নয়। আমরা তরুণরা এখন তথ্যের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। মিম, নিউজ লিংক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় রিলের মাধ্যমেই হোক না কেন, এটি তথ্যের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। সমস্যাটি হ’ল এটি একটি সীমিত ক্ষেত্র সরবরাহ করে। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করে যে এটি এক ধরনের তথ্যই ভোক্তাদের কাছে বিতরণ করে।
যেমন জাতপাত বা ধর্মের নামে বৈষম্য বা দাঙ্গার পর আপনি যদি একই ধরনের গ্রুপ বা পেজে জয়েন করেন, তাহলে সবরকম তথ্য আসতে শুরু করে। এখন এই গ্রুপগুলোর কাছ থেকে যে তথ্য আসছে তাতে মনে হয় সারা দেশেই একই ধরনের কার্যক্রম চলছে, যা পুরোপুরি সঠিক নয়।
একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবির প্রচার হয়। যেমন, ‘অ্যানিম্যাল’, ‘গদর’, ‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’ ছবিগুলো মুক্তি পেলে তাদের ফ্যান পেজ তৈরি হতে শুরু করে। এসব ফ্যান পেজগুলোর কোনো পোস্টে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে এটি বেশি করে একই ধরনের কনটেন্ট পাঠানো শুরু করে, যার ফলে মস্তিষ্ক একটি জিনিসে পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। অর্থাৎ, জোর করে আপনার মধ্যে আগ্রহ তৈরি করা হয়।
এখন ভালো হোক বা খারাপ, টেকনিক্যালি এটা আপনার রান্নাঘরের রেসিপি বইয়ের মতো। অ্যালগরিদমের গুণমান নির্ভর করে আপনি কেমন মেজাজের এবং আপনি কী ধরনের পরীক্ষা পছন্দ করেন তার উপর। আপনি যদি বেশি ভাজা পছন্দ করেন তবে সে আপনার সামনে একই ধরনের উপাদান পরিবেশন করবে। এখন আপনি এটা দিয়ে কি বানাবেন, এটি আপনার উপর নির্ভর করে এবং আপনিই এর পরিণতি ভোগ করবেন।
কী ভাবে এটি ঠিক করবেন
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রভাব নিজের উপর বিস্তার করার আগেই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করাই বাঞ্ছনীয়। এটি করার উপায়ও রয়েছে, যেমন ফেসবুক টাইমলাইন থেকে বাছাই করা অ্যালগরিদমগুলি অপসারণের অনুমতি দেয়।
ফেসবুকে, নিউজ ফিডের পাশের ৩ টি বিন্দুতে ক্লিক করুন, তারপরে ‘রিসেন্ট’-এ ক্লিক করুন। অ্যাপটিতে ‘সেটিংস’, তারপরে ‘শো মোর’ তারপরে ‘রিসেন্ট’ ক্লিক করতে হবে। এতে প্রভাব কমবে।
একইভাবে, এটি ইউটিউবে ঠিক করা যেতে পারে। এতে অটোপ্লে বন্ধ করে অন্তত আপনি কিছুটা হলেও ইউটিউব অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। ফেব্রুয়ারিতে বেশ কিছু আপডেট এনেছে ইনস্টাগ্রাম।
ইনস্টাগ্রাম আপনাকে অজান্তেই একটা বিকল্প দিচ্ছে। কাকে উপেক্ষা করছেন তার তথ্য আপনি পেয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ আপনি কোন ধরনের কনটেন্ট বেশি দেখছেন তা অল্প হলেও বুঝতে পারছেন। এর জন্য আপনি আপনার প্রোফাইলে গিয়ে ‘ফলোয়িং’ এ ক্লিক করবেন। এই দিয়ে আপনি শুধু, নিজেকে রিফ্রেশ বা পুনরায় আশ্বস্ত করতে পারেন তবে আপনি Algorithm থেকে মুক্তি পেতে পারবেন না।