এরপর গেলাম নায়াগ্রা হর্ন ব্লোয়ার ক্রুজ-এ। যাত্রীদের নিয়ে এই ক্রুজ নায়াগ্রা ফল্স-এর একদম কাছে চলে যায়। সবাইকে লাল রঙের প্লাস্টিকের রেইন কোট পরতে হল। তবে নায়াগ্রার জলের বিপুলতার কাছে এই রেইন কোট নিতান্তই হাস্যকর। বোটে করে আমেরিকান ফল্স, ব্রাইডাল ভেইল ফল্স এবং সবশেষে কানাডিয়ান হর্স শু ফল্স ঘুরে ফিরে আসা। যে দিকে চোখ যায় শুধুই জল। প্রকৃতির এই রূপ বর্ণনা করা সত্যিই অসম্ভব। একমাত্র হৃদয় দিয়েই একে উপলব্ধি করা যায়।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল। সামনেই একটা রেস্তোরাঁতে ডিনার করার জন্য আগে থেকেই বুকিং করা হয়েছিল। জানলার ধারের টেবিল থেকে নায়াগ্রার অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে ডিনার করার সুখ হয়তো এ জীবনে দ্বিতীয় বার আসবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল আলোর খেলা, সাথে অন্ধকারের বুক চিরে আতশবাজি আর আলোর ফুলকি। এখানে প্রতি শুক্রবার রাতে টুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য আলো আর আতশবাজির খেলা চলে। ডিনারের পরও অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই আলো আঁধারি নায়াগ্রার সৌন্দর্য উপভোগ করে, বুকে এক রাশ ভালো লাগা নিয়ে প্রায় মধ্য রাতে হোটেলে ফিরলাম।

টরোন্টোতে আজই আমাদের শেষ দিন। কাল সকালে বিদায় জানাতে হবে এই মনোরম শহরকে। তাই সকালে উঠেই সারাদিনের পরিকল্পনা করে বেরোলাম। মিউজিয়ামের প্রতি আমার আসক্তি বরাবরের। নতুন কোনও জায়গায় যাবার আগে খুঁজে দেখি সেখানে মিউজিয়াম আছে কিনা। অনেক দেশের অনেক মিউজিয়াম ঘুরে দেখেছি, তবে কানাডার রয়াল ওন্টারিও মিউজিয়াম সত্যিই চিত্তাকর্ষক। মিউজিয়ামের প্রতিটি কোণায় কোণায় আমার মতো মিউজিয়ামপ্রেমী মানুষদের জন্য অপেক্ষা করে আছে বিস্ময় আর ভালো লাগা। এটাই কানাডার সব থেকে বড়ো মিউজিয়াম। এখানে পুরাতত্ত্ব (Archaeology), জীবাশ্ম বিজ্ঞান (Palaeontology), খনিজ বিদ্যা (Mineralogy), প্রাণী বিদ্যা (Zoology) এবং ভূ-তত্ত্ব (Geology) বিষয়ক বিভিন্ন বস্তু স্ব- মহিমায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছে।

মিউজিয়ামে ঢুকে মনে হল যেন কোনও পাঁচ তারা হোটেলে ঢুকছি। মিউজিয়ামে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল বিশালাকার ডাইনোসরের কঙ্কাল। এতই বড়ো যে উপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলে ঘাড় ব্যাথা শুরু হবে। এর আশেপাশে কয়েক শো বিভিন্ন আকারের ডাইনোসরের কঙ্কাল সাজানো রয়েছে। এরপর দেখলাম রোমান, মিশর এবং চীনের সভ্যতার নিদর্শন। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই চোখ আটকে গেল ভারতীয় সভ্যতার প্রদর্শনীতে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের রাজপরিবারের বিভিন্ন সময়ের কতরকম শিল্পকলার নিদর্শন পেলাম এই মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে। তার মধ্যে চিত্র, সোনা এবং নানারকম মণিমুক্তাখচিত অলংকার থেকে শুরু করে মহারাজ মান সিং এবং তার পরিবারের অনেক রকমের আসবাবপত্রও রয়েছে।

রয়াল ওন্টারিও মিউজিয়ামের আরেক দিকে রয়েছে খনিজ পদার্থের প্রদর্শনী। এখানে তিন হাজারেরও বেশি দেখার মতো বস্তু আছে। খনিজ পদার্থ, রত্ন, উল্কা পিণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের অমূল্য পাথর দিয়ে সাজানো এই প্রদর্শনী। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে এদের সংগ্রহ করা হয়েছে। এই মিউজিয়ামের সুবিপুল আর্ট কালেকশনের মধ্যে স্থান পেয়েছে স্বনামধন্য বাঙালি পেইন্টার যামিনী রায়-এর নৃত্যরত গোপীর পেন্টিং। ১৯৫০ সালে আঁকা এই চিত্রটি শুধু বাঙালির গর্বের বিষয় নয়, এটা অনেক চিত্রপ্রেমী টুরিস্টের মনে একটা বিশেষ দাগ রেখে যাবে।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...