শ্রীরামপুর থেকে খিদিরপুরে এসে প্রথমে ইন্দ্ররা ভাড়া থাকত মায়ের মাসিদের বাড়ির কাছে। এখানে তারা পাঁচ বছর কাটিয়েছে। পরে ইন্দ্রর বাবা সেখান থেকে খানিকটা দূরে খিদিরপুরেই নতুনপাড়ায় বাড়ি করে। যে-বছর ইন্দ্র ফিজিক্স অনার্স পাশ করে, সে বছরই ওর বাবা এখানে বাড়ি করে বসবাস শুরু করে। বাড়িটা এখন দোতলা হয়েছে। তার মধ্যে ছোটোভাইয়ের চেম্বার আছে। বোনের বিয়ে হয়েছে দুর্গাপুরে। বোন ইতিহাসে এমএ।

বিয়ের কথা হলেই ইন্দ্রর মনে পড়ে যায় বোনের বিয়ের কথা। কত আনন্দ হয়েছিল। বাড়ির প্রথম বিয়ে। অন্তত এ বাড়িতে। শ্রীরামপুর থেকে ইন্দ্ররা ছিন্নমূল হলেও ওখান থেকে খিদিরপুরে অনেকেই এসেছিল। ঠাকুমার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় কলকাতায় বাবার অফিসের সুবিধের জন্য মাসির প্রস্তাব একবাক্যে গ্রহণ করেছিল ইন্দ্রর মা। মায়ের মাসি কাছাকাছি থাকায়, ইন্দ্রদের মামারবাড়ির টানটাই বেশি। শ্রীরামপুরের তুলনায়। চলে আসার পরও, ছুটি থাকলেই ইন্দ্ররা শ্রীরামপুর যেত। তাতেও ঠাকুমা কথা শোনাত, ‘তোরা তো কলকাতার লোক, শ্রীরামপুরে ফিস্ট করতে এসেছিস!’

কাকাদের সঙ্গে যৌথবাড়ি ইন্দ্রদের। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলেও খিদিরপুরের মতো জায়গায় থাকায় তাতে অসুবিধা কিছু হতো না। সুযোগ সুবিধা বেশি থাকায় তা পূরণ হতো। কলকাতায় থাকার আনন্দই আলাদা। সুযোগ সুবিধা তো আছে। লোকে বলে কলকাতায় বাঘের দুধও মেলে! তার ওপর খিদিরপুরে একটা ফ্যান্সি মার্কেট আছে।

ইন্দ্ৰ তখন ক্লাস এইটে উঠেছে, তখনই ওরা শ্রীরামপুর ছেড়ে খিদিরপুরে চলে আসে। খিদিরপুরে একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। ওখান থেকেই বারো ক্লাস পাশ করে স্টার মার্কস নিয়ে। জয়েন্টে সেবার ভালো কোচিং নেয়নি। বেলুড়ে আবাসিক কলেজে ভর্তি হওয়ার পরের বছর আর জয়েন্ট দেওয়া হয়নি।

ইন্দ্রর অনার্সের রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় কোনও ইউনিভার্সিটিতে এমএসসি অ্যাডমিশন পেল না। ফলে তার আর মাস্টার্স করা হল না। মাথায় তখন ডব্লুবিসিএস, আইএএস, ফরেস্ট সার্ভিস ও অন্যান্য পিএসসি-র বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বসার চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু চাকরি পাওয়া যে এত শক্ত তা কে জানত! ফিজিক্স-এ অনার্স থাকলে প্রসার ভারতীতে আবেদনপত্র দেওয়া যায়। কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিতে কেস বাধা হয়ে পড়ল৷

দেখতে দেখতে ইন্দ্রর এসএসসি পরীক্ষার বয়স সাঁইত্রিশ পার হয়ে গেছে। যদিও ইন্দ্র যখন পাশ করেছিল স্কুলে চাকরির জন্য এমএসসি হয়নি। যখন এমএসসি হল ইন্দ্রর বয়স তখন প্রায় ত্রিশ। ফিজিক্স অনেকটাই ভুলে গেছে। বত্রিশ পর্যন্ত পিএসসি-র চাকরি। সব নিয়ে পড়তেই হবে কেন না এমএসসি, বিএড থাকলেও হতো।

চাকরি থেকে অবসর জীবনে একবার বসে গেলে, বসে যেতেই হয়। ইন্দ্রের বাবার যেমন হয়েছে, তেমন পড়াশোনার জীবন থেকে বসে গেলে চাকরি পেতে বেশি ভোগান্তি হয়। তার ওপর কিছু রোজগারের তাগিদে টিউশন করতে হয়। টিউশন করলে জ্ঞান বাড়ে ঠিকই কিন্তু অনেক টিউশন শুধু টিউশনই করা এই যা! কলকাতায় টিউশনির বেতন ভালো, শুধু টিউশন করে অনেকে প্রতিষ্ঠিত হলেও ইন্দ্রর এইদিকে কোনওদিনই ইচ্ছা ছিল না। চাকরির পরীক্ষার পোস্টাল অর্ডার ও হাত খরচা চালাতেই ওকে টিউশন করতে হতো।

বেলুড় থেকে ইন্দ্রদের আসা আর নতুন বাড়িতে উঠে আসার আগে, মাঝে খিদিরপুরে পাঁচ বছর কাটানো ইন্দ্রর কাছে নতুন নতুন ঠেকে ছিল। বেলুড়ে তিনবছর থাকাই এর প্রধান কারণ। বেলুড়ে যাওয়ায় ইন্দ্রর চরিত্রে একটা সর্বজনীন ব্যাপার এসেছে, যেটা কলকাতায় অনেক লোকের মধ্যেই আছে— মিশুকে, কূপমণ্ডূক নয়। তার আগে পড়াশোনা নিয়ে থাকলেও বন্ধু-বান্ধব হয় বিভিন্ন জায়গার ছেলের সঙ্গে, তবে বেশিরভাগই মেদিনীপুরের গ্রামের ছেলে।

(দুই)

বেলুড়ে গিয়ে বর্তমান সময়ে যাকে ‘পাকা” বলে সেরকম ইন্দ্র একটু হয়ে উঠেছিল। আগে খিদিরপুরে কো-এড পড়ার সুযোগ পায়নি ইন্দ্ৰ৷ বেলুড়েও সেই একই অবস্থা।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...