মেজদা ছিল খুবই শান্ত স্বভাবের। ঘরে-বাইরে, পাড়া-প্রতিবেশি, এমনকী স্কুলেও তার খুবই সুনাম ছিল। সংসারের খুঁটিনাটি অনেক ব্যাপারে মেজদা মায়ের কাছে বেশি গুরুত্ব পেত। মা সব্বাইকে বলত, ওর বয়স কম হলে কী হবে, অপু আমার খুব বুঝদার ছেলে। আমি খুব ভরসা করি ওকে।
আমার বেশ মনে পড়ে, বিকেলে মেজদা সেজদা খেলতে গেলেও আমাদের ছোটো দুই ভাইবোনকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে মাঠের ধারে বসিয়ে রাখত। কখনও খেলা ফেলে এসে আমাদের সঙ্গ দিত। এ হেন মেজদার ওই অবস্থা দেখে আমরা একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। বড়ো হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি, কখনও সখনও জ্বরজারি হলে বা শরীর খারাপ করলেও সেই কষ্টটা মেজদা প্রকাশ করত না। বলত, ‘না না, আমার তেমন কিছুই হয়নি মা গো।”
মেজদাকে যে-ঘরে শোয়ানো ছিল সেই ঘরের মেঝেতে আমরা বসেছিলাম। বাবার বন্ধু প্রফুল্ল কাকু রোজ আমাদের বাড়ি আসতেন। তিনি প্রায় আমাদের বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। কাকু দুঠোঙা মুড়ি মুড়কি এনে আমাদের হাতে দিয়ে বললেন তোরা বসে কী করবি। সেই দুপুরে তো খেয়েছিস। নে মুড়ি ক’টা খেয়ে নে। এক মুহূর্তে যেন আমরা অনেকটা বড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। ঠোঙাটা মুড়ে রেখে দিয়েছিলাম। তা থেকে একটা দানাও মুখে তুলতে পারিনি।
খানিকবাদে আবার বমি হল মেজদার। আশেপাশে দাদা, দিদি, ছোড়দি, মেজদি সবাই ঘিরে বসে রয়েছে। দিদি বলছে অপু, বাবা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এখনই এসে পড়বে। কিন্তু মেজদা অস্ফুট গোঙানির স্বরে বলতে লাগল, “দিদি, আমি আর ভালো হবো না রে! মা কোথায়? আমার চোখটা কেমন যেন ঝাপসা লাগছে, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না! মা… মা তুমি একবার আমার হাতটা ধরো না।’ মেজদার মুখের সামনে মুখ নিয়ে এসে মা বলল, এই তো আমি বাবা!
এতক্ষণ মা মেজদার পাশেই বসে ওর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎই মেজদাকে ভীষণ রকম শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে দেখে মা উঠে পাশের ঘরে গিয়ে ঠাকুরের সামনে পড়ল।
বৃষ্টি যখন একটু ধরে এসেছে বাবা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে ফিরলেন। ডাক্তারবাবু এসে মেজদাকে দেখে বললেন, এক্ষুনি অক্সিজেন দেওয়া দরকার। আপাতত, একটা ইনজেকশন দিচ্ছি। একটু চেষ্টা করে দেখুন যদি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে পারেন। গোবিন্দকাকুকে নিয়ে বাবা আবার বেরোলেন।
বাইরে ঝড়বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। ডাক্তারবাবু ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন। ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে মেজদা যেন শুধু মাকেই খুঁজে চলেছে, আর বিড়বিড় করে অনেক কিছু বলে চলেছে। আমি আমার হাতদুটো মেজদার পায়ের উপর রাখলাম। একবার চোখটা একটু আধখোলা করে বলল, “তোরা ভালো হয়ে থাকবি। মাকে জ্বালাতন করবি না।”
জেঠিমা পাশের ঘরে গিয়ে মাকে বললেন থাক পড়ে তোর ঠাকুর। আগে ছেলের কাছে চল, বলে মাকে ধরে নিয়ে এসে মেজদার পাশে বসিয়ে দিল। মেজদা কষ্ট করে ওর হাতটা তোলার চেষ্টা করতেই মা হাতটা ধরে ফেলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল অপু, এই তো আমি। দেখ বাবা, এই তো আমি!
মেজদা অস্ফুটে বলল, ‘মা মাগো, আর পারছি না, এবার আমি ঘুমোব। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। ছোটোদুটোকে (আমাদের দুই ভাইবোনকে) তুমি দেখো, দুষ্টমি করলে ওদের বকবে কিন্তু মারবে না!”
কথা থেমে আসছিল মেজদার। তাও জোর করে বলল, ‘মা… আর বোধহয় তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।’
মা বলল, “না বাবা না, দেখা হবে। আমি বলছি দেখা হবেই, আর একটু কষ্ট কর, তোর বাবা এখনই এসে পড়বে!”
দুর্যোগ একেবারে থেমে গিয়েছে। বাইরে গাড়ির শব্দ। বাবা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে একছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেন। তখনও মায়ের হাতের মধ্যে মেজদার হাতটা ধরা রয়েছে। মেজদা খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হুঁ… উ… হুঁ… উ, তার চোখ ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গোঙানির শব্দে মেজদা তখনও বলে চলেছে, ‘বাবা… তাড়াতাড়ি এসো না। আর সময় নেই যে! আর সময়…।’ থেমে গেল মেজদার কথাগুলো। অঘটন যে ঘটতে চলেছে সেটা বুঝতে কারওরই বাকি রইল না।
মা মেজদার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলতে লাগল— দেখা হবে বাবা, নিশ্চয়ই দেখা হবে।
বাবা ঘরে ঢুকেই বললেন ডাক্তারবাবু, শিগগিরই অক্সিজেনটা লাগান। ও ভালো হয়ে যাবে! মেজদার হাতটা মায়ের হাতে তখনও ধরা ছিল।
ডাক্তারবাবু মেজদার হাতটা মায়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘অক্সিজেন আর লাগবে না!” বলেই মাথা নীচু করে নিলেন। সকলে স্তম্ভিত। কাকিমা জেঠিমাদের মুখে আঁচলের খুঁট। দাদা দিদি চিৎকার করে উঠল। তখনই মা ছুটে গিয়ে পাশের ঘরে দরজা দিয়ে দিলেন। আর বাবা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন। সেই রাতটাও চোখের সামনে আজও দেখতে পাই।
দুঃসংবাদ পৌঁছোতে সময় লাগেনি। ভোরের আলো ফুটতেই বুঝেছিলাম আজকের ভোরটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। বড়দা আর বাবা ছোটাছুটি করছে আত্মীয় পরিজনকে দুঃসংবাদ পাঠানোর জন্যে। আমার মনে আছে, মেজদার নিষ্প্রাণ দেহটা শোয়ানো আছে আর আমরা ছোটো দুজন পাশে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি মুখের দিকে। কান্না গুমরে উঠলেও চোখের জলটা পড়ছে না, শুকিয়ে গিয়েছে। মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণাটা তখনই সদ্য পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে।
ধীরে ধীরে সারা বাড়িটা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল। প্রত্যেকের মুখেই মেজদার প্রশংসা শুনছি। ওতটুকু বয়সে সে সকলের মন জয় করে নিয়েছিল। মেজদাকে দাহ করার জন্যে নিয়ে যাবার সময় অনেক ডাকাডাকি করার পরেও মা দরজা খোলেনি। পরে কাঠ-মিস্ত্রি নিয়ে এসে দরজা খুলিয়ে দেখা গিয়েছিল মা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।
সব শেষ! জোড়া উপনয়ন ভেঙে গেলো…
মেজদা মারা যাবার পর মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। একঢাল কালো চুল পিঠ ছাড়িয়ে হাঁটুর নীচে দুলত আর প্রতিমার মতো মুখ আমার মা খুব উদাস মুখে আমাদের সামনে ঘুরে বেড়াত। যেন শরীরটাই আছে বাকি সবটুকু মেজদা নিয়ে চলে গিয়েছে। আমরা কাছে গেলে মা সহ্য করতে পারত না। ঠেলে সরিয়ে দিত। বারকয়েক বিভিন্ন ভাবে নিজেকে শেষ করে দেবার চেষ্টাও করেছিল! মাকে সুস্থ করার জন্যে বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কিছুতেই মাকে প্রতিদিনের জীবনে ফেরানো যাচ্ছিল না। শেষে ডাক্তারের পরামর্শে ওই বাড়িটা ছেড়ে আমরা অন্যত্র চলে গিয়েছিলাম।
সেখানে একদিন মাঝরাতে মা বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে সবে বাইরে বেরোতে যাচ্ছে, ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। আমরা ছোটো দুই ভাইবোন মায়ের শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎই মা আমাদের দু’জনকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল আর তারপর মা যত কাঁদছে আমরাও তত কাঁদছি। মেজদা মারা যাওয়ার পর মাকে সেই প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম। এর পর ধীরে ধীরে মা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।
তারপর বহু বছর কেটে গিয়েছে। স্মৃতি ফিকে হয়ে গিয়ে জীবন স্বাভাবিক ছন্দে চলতে চলতে অনেকটা পথ পেরিয়ে গিয়েছে। ততদিনে বাবা মারা গিয়েছেন। আমার অসুস্থ মেজদিও মারা গিয়েছে। মা সব শোকতাপ মেনে নিয়ে ঠিকই ছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম মা হয়তো মেজদার কথা ভুলে গিয়েছে।
ক্রমে ক্রমে মায়েরও বয়স বাড়ল। হঠাৎ-ই একদিন মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাক্তার ঘর আমাদের সব প্রচেষ্টা বিফলে গেল। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ক’টা দিন বাড়িতেই রাখুন। সময় বেশি নেই।”
দিন চারেক ঠিকই ছিল। মারা যাওয়ার আগেরদিন রাত্রিবেলা থেকে সবাইকে চমকে দিয়ে মা মেজদার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল— অস্ফুট ক্ষীণ স্বরে অপু, অপু…
মুখের কাছে মাথা নিয়ে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। আমরা ভাইবোনেরা মা মা করে ডেকেও কিছুতেই সাড়া পাইনি। সন্ধে থেকেই মা কিছুটা যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। যদিও একই ঘরে আমরা সকলেই ছিলাম তবুও সবাইকে ঘুমোতে বলে আমি মায়ের পাশে বসেই রইলাম। ভোরের দিকে আমার একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। অপু নামটা আবার কানে আসতেই তাকিয়ে দেখি, মা ভীষণরকম ছটফট করছে আর খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে।
অসংলগ্ন ক্ষীণ স্বরে একই কথা বলছে— অ…প..পু, এ…ই তো আ…মি! আসছি… দেখা অ…বে..ই! বুঝলাম মাকে আর ধরে রাখা যাবে না! ‘মা মা’ করে ডেকেও সাড়া না পেয়ে আমি মায়ের হাতটা ধরতেই, হাতটা পড়ে গেল বিছানায়। মা চলে গেলেন।
মেজদার সঙ্গে মায়ের দেখা হয়েছিল কি না আমার জানা নেই। ভেবেছিলাম হয়তো সময়ের সাথে সাথে মা নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় মেজদাকে দেওয়া কথাটা আমার মা যে হৃদয়ের এত গভীরে এতদিন ধরে লালন করে রেখেছিল। সেটা মায়ের মৃত্যুশয্যায় আমরা জানতে পারলাম।
আমাদের মনের গহিনে অনেক কিছুই লুকিয়ে বিরাজ করে। অবচেতনে সুপ্ত থেকে যায় অনন্তকাল। আজও মাঝে মাঝে মায়ের কথা মনে এলেই মায়ের গায়ের সেই গন্ধটা অনুভব করতে পারি। মনে মনে মায়ের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি।