কাশ্মীর ভ্রমণ বলতেই সকলের মুখে মুখে যে শব্দগুলো ঘুরপাক খায় তা হল—  বরফে ঢাকা গুলমার্গ, সোনমার্গ, পহেলগাঁও-এর মতো পাহাড়; আপেলখেত, আখরোট, পেস্তা, স্ট্রবেরি, চেরি, টিউলিপ-এ ভরা একের পর এক বাগান। আর এই সবকিছুর মধ্যমণি ডাল লেক। কাশ্মীর ভ্রমণের এইসব বহুল চর্চিত বিষয়াবলির সবিশেষ বিবরণ দিতে গেলে, প্রয়োজন সুদীর্ঘ এক পরিসরের। কাশ্মীর ভ্রমণকালে দর্শন প্রাপ্তি হয়েছে, এমন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কয়েকটা জায়গার কথা আজ বলব যা প্রথাগত সফরসূচির মধ্যে অনেকে রাখেন না।

ডাল লেক

শ্রীনগরের প্রাণভোমরা ডাল লেকের বুকে শিকারা ভ্রমণ করতে করতে যেদিকেই চোখ যাক না কেন,, সকলেরই নজরে পড়বে বরফাচ্ছাদিত পীর পাঞ্জাল পর্বতমালার সারি। সেই ডাল লেকের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে সুবিশাল এক দুর্গ মাথায় নিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘হরি-পর্বত’। আর তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে রয়েছে “জাবারওয়ান’ পর্বত। যার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘শঙ্করাচার্য মন্দির’ বহু দূর থেকে দেখলেও কারও নজর এড়ায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ডাল লেকের ধারে কাছে যে-কটা এমন দর্শনীয় স্থান আছে, সর্বাগ্রে তা দেখে নেওয়ার।

নির্ধারিত দিনে হোটেল থেকে প্রাতঃরাশ সেরে একটা এসইউভি গাড়িতে চড়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম শ্রীনগর সংলগ্ন অঞ্চলের কয়েকটা ধর্মীয় স্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থল নির্ধারিত হল ‘হজরতবাল’ মসজিদ। শ্রীনগরের ডাউনটাউন অঞ্চল ছেড়ে দু-কদম এগোতেই পুরাতন শ্রীনগরের ‘নওহাট্টা’ অঞ্চলে নজরে পড়ল “জামা মসজিদ’। বসির জামা মসজিদের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়ে, মসজিদের সবিশেষ তথ্যাবলি পেশ করতে শুরু করল।

নওহাট্টা-জামা মসজিদ

সুবিশাল এক অঞ্চল জুড়ে ‘ইন্দো-ইসলামিক’ স্থাপত্যের এক অপরূপ নিদর্শন হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই জামা মসজিদ। তিনশো চুরাশি ফিট দৈর্ঘ্য এবং তিনশো একাশি ফিট প্রস্থ সম্বলিত এই মসজিদের চারদিকে রয়েছে চারটে পিরামিড-সদৃশ গম্বুজ-সহ তোরণ। যার ভিতরে রয়েছে ৩৭১ টি দেওদার কাঠের স্তম্ভের উপরে নির্মিত সুবিশাল এক নামাজ পড়ার কক্ষ। যেখানে একসঙ্গে প্রায় তেত্রিশ হাজার ভক্ত নামাজ পড়ে প্রতি শুক্রবার।

১৩৯৪ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সুলতান সিকান্দর। তবে ১৮১৯ সাল থেকে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত একুশ বছরব্যাপী শিখ রাজত্বের সময় মহারাজা রণজিৎ সিং-এর দেওয়ান মতি রামের নির্দেশে এই জামা মসজিদে প্রার্থনা সভা পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছিল। এছাড়া, এই জামা মসজিদ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে পবিত্র চিরপ্রসিদ্ধ এক প্রার্থনাক্ষেত্র হিসাবে পরিগণিত হয়ে এসেছে বরাবর। আমাদের পরিভ্রমণ কালে, মসজিদে প্রবেশাধিকার না থাকায়, বাইরে থেকেই মসজিদ সংক্রান্ত তথ্যাদি আহরণে তৃপ্ত হয়ে, আমাদের এগিয়ে যেতে হল ‘হজরতবাল মসজিদ’ দর্শনের উদ্দেশ্যে।

হজরতবাল

ডাল লেকের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ঘিঞ্জি এক জনবহুল অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘হজরতবাল মসজিদ। মসজিদের প্রবেশ পথে বসানো মেটাল ডিটেক্টটর ফ্রেম একটা রয়েছে বটে কিন্তু অধিকাংশ দর্শনার্থী বা পর্যটকই তার ভিতর দিয়ে প্রবেশের আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথরে ঢাকা সুবিশাল মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢোকামাত্র, যে-কোনও মানুষের মন এক প্রশান্তিতে ভরে যাবে, এমনই সুন্দর এক পরিবেশ। প্রথানুসারে, সকল পুরুষরা পকেট থেকে রুমাল বের করে, মাথায় বেঁধে নিচ্ছে; আবার মহিলারা হয় তাদের আঁচল বা ওড়না জড়িয়ে নিচ্ছে মাথার উপর দিয়ে।

মুসলিমদের বিশ্বাস এই হজরতবাল মসজিদের ভিতরে হজরত মহম্মদের চুল (মৈ-এ-মুকদ্দস) সংরক্ষিত আছে। ডাল লেকের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এই মসজিদ কাশ্মীরি মুসলমানদের কাছে পবিত্রতম এক মসজিদ বলে পরিগণিত। মোঘল সম্রাট শাহাজাহানের রাজত্বকালে, সপ্তদশ শতাব্দীতে সুবেদার সাদিক খান এই মসজিদের নির্মাণকার্য শুরু করেছিলেন।

যে স্মারকপাত্রের মধ্যে হজরত মহম্মদের ‘চুল’ সংরক্ষিত আছে, তা এদেশে নিয়ে আসেন ‘সৈয়দ আবদুল্লা মাদানি’ নামক হজরত মহম্মদের এক বংশধর। সৈয়দ আবদুল্লা মাদানি ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতের বীজাপুরে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে, তাঁর অযোগ্য পুত্র সৈয়দ হামিদ, হজরত মহম্মদের ওই কেশ-পাত্র তাদের অন্যান্য সম্পত্তির সাথে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তুলে দেন খাজা নুরউদ্দিন ইশাহি নামক কাশ্মীরের এক ধনী ব্যবসায়ীর হাতে।

মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এই সংবাদ জানতে পেরে প্রথমে নুরউদ্দিন ইশাহিকে গ্রেফতার করেন এবং তার থেকে হজরত মহম্মদের স্মারক কেশ-পাত্র উদ্ধার করে আজমীরের মৈনউদ্দিন চিস্তির কাছে প্রেরণ করেন। পরে সম্রাট ঔরঙ্গজেব ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে, স্বপ্নে স্বয়ং হজরত মহম্মদের নিকট থেকে এক নির্দেশ পাওয়ার পরে— ওই কেশ-পাত্র-সহ নুরউদ্দিন ইশাহির মৃতদেহ এই ‘হজরতবাল মসজিদ’-এ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।

তবে বিদ্বজনেরা মনে করেন, ‘হজরত-বাল’ শব্দটা এসেছে ‘হজরত’ এবং ‘বাল’ নামক দুটি আরবি শব্দ থেকে। যার অর্থ যথাক্রমে ‘শ্রদ্ধেয়’ এবং ‘স্থান’; অর্থাৎ শ্রদ্ধার স্থান।

(ক্রমশ……)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...