অতনুকে সে নিজের গরজে ডেকে কাছে বসতে অনুরোধ জানায়। ভেজা জামা কাপড়ের দোহাই দিয়ে অতনু একটু দূরে বসে। শিবনাথ মেনে নেয় কথাটা। কোনও আপত্তি করে না। তারপর কৌতূহলাদ্দীপক স্বরে প্রশ্ন করে— কতদিন বাদে দেখা তাই না? তুই কেমন আছিস? বাড়ির সবাই ভালো তো? একই ভাবে বলতে থাকে এই একটু আগেই তোর কথা ভাবছিলাম মনে মনে। এত ভোরে তুই এখানে কী করে? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে শিবনাথ নিজেই সেই প্রশ্নের জবাবদিহি করে! ও বুঝেছি, হয়তো এখানে কোথাও চাকরি করিস সেই সূত্রে এখানে থাকা হয়। কাল রবিবার ছুটির দিন তাই বাড়ি যাওয়ার তাড়া। তাই না?

অতনু শিবনাথের কথায় বিশেষ আমল না দিয়ে বলে— পৃথিবীর সর্বত্রই রহস্যে ঘেরা। ও-কথা এখন থাক। দেখা যে হল সেটা যথেষ্ট নয় কী?

শিবনাথ স্বীকার করে কথাটা। সন্মতিসূচক ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে বলে— – জানিস, আজকের সকালটা দারুণ লাগছে আমার কাছে। এমন সুন্দর সকাল আগে কখনও দেখিনি। কোনও দিন উপভোগ করেছি বলে মনে পড়ে না। মানুষ হয়ে জন্মেও জীবনের অনেক কিছুই শেষ পর্যন্ত অদেখা রয়ে যায়। উত্তেজনাবশত গতরাতে আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বাড়ি ফেরার আনন্দে মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল।

—রাঁচির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে রাতজাগা কনে বউয়ের সঙ্গে তুলনা করলেও বোধহয় অনেক কিছুই তার ‘না বলা বাণীর ঘন যামিনীর আড়ালে চাপা পড়ে থাকে।

—–বাঃ! উপমাটা তো খুব সুন্দর। একেবারে কালিদাসস্য। তোর গল্প লেখার অভ্যেসটা এখনও কী বজায় আছে? নাকি ছেড়ে দিয়েছিস? শিবনাথ আরও জানায়, আমি সাহিত্যরসিক নই মোটেই, কোনও দিন ছিলামও না, তবে এটুকু নিশ্চয়ই হলফ করে বলব যে, গল্পগুলো যখন পড়ে শোনাতিস তখন মনে একটা সাড়া জাগত, আলোড়ন সৃষ্টি হতো, তাতেই মনে হতো তোর গল্প লেখার হাত ভালো ছিল। তবে হাত তো সবারই থাকে কিন্তু গল্প লিখতে পারে ক’জনে? গল্পের ভালোমন্দ বলতে আমি শুধুমাত্র এইটুকুই বুঝি

—হ্যাঁ, লিখতাম এককালে। তবে নিয়ম করে এ জীবনে কিছুই করা হয়নি। খেয়াল খুশি মতো যখন ইচ্ছে হতো তখন লিখতাম। একটু থেমে অতনু নিজের অভিমত প্রকাশ করে বলে, দেখি পরজন্মে যদি ভগবান সহায় হন তাহলে আবার চেষ্টা করব। আমার ইহজন্মের খেলা শেষ।

—এত হতাশা কেন? তুই ডিপ্রেশনে ভুগছিস নাকি?

শিবনাথের কথাটা এড়িয়ে গিয়ে অতনু তাকে অন্যমনস্ক করার অভিপ্রায় হঠাৎ বলে ওঠে— ওই পাখিটাকে দেখতে পাচ্ছিস? ওটা শ্যামা পাখি নামে খ্যাত। নিতান্তই ভীতু স্বভাবের। লোকচক্ষুর অন্তরালে পার্বত্য জঙ্গলের গভীরতম প্রদেশে ওদের গৃহস্থালী। এই সুযোগে একটু রসিকতা করার লোভ সম্বরণ করতে না পেরে বললে, অনেকটা তোর মতো অবস্থা। তোরও জঙ্গলে বাস ওদের মতো। তবে রাঁচিতে কেউ ওদের বড়ো একটা দেখতে পায় না, একমাত্র জোনহার পার্বত্য জঙ্গল ছাড়া।

—আবার শুরু কর লিখতে। মুচকি হেসে শিবনাথ এবার কাব্য করে বলল, ‘শেষ হইয়াও হয় নাই শেষ’। যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ নিঃশেষে করো হে তাহা দান । তোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণ রসবোধ আছে, আর্ট জ্ঞান আছে। এগুলোকে কাজে লাগা। নিজের খেয়াল খুশি মতো অবহেলা করিস না। জানবি তোর উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছিল। একটু রসিকতার সুরে বললে, হায়! —যে ধনে হইয়া ধনী মনিরে মান না মনি তাহারই ক্ষণিক মাগি আমি নত শিরে ।

এবারও শিবনাথের কথায় কর্ণপাত না করে পালটা প্রশ্ন করে অতনু— মালভূমি রাঁচি সাগরাম্বু রেখা থেকে কত হাজার ফুট উঁচু জানিস? উত্তরের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ মৌন থেকে তারপর নিজেই জবাবদিহি করে ন্যূনাধিক দু’হাজার ফুট। জায়গায় জায়গায় তিন সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড় মাথা তুলে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে এই মালভূমি প্রায় সমান। অন্তত পঞ্চাশ ষাট মাইলের কম নয়। স্রোতস্বিনী পার্বত্য নদীগুলো তিলক কামোদ রাগিনীতে গান গেয়ে পাহাড়ের পাদদেশ ধুইয়ে দিতে থাকে। বড়ো নদীর মধ্যে দামোদর এঁকে বেঁকে এর এক প্রান্তসীমা বেয়ে সাপের মতো ছুটে চলেছে। হুডরু জলপ্রপাতের শুভ্র ফেনপুঞ্জময়ী সুবর্ণরেখার লাস্যলীলা সমস্ত মালভূমির উপর শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে আছে। মানুষের স্থাপত্য কৌশলে জায়গায় জায়গায় বাঁধ তৈরি করে কৃত্রিম হ্রদের জন্ম হয়েছে। পাথরসংকুল হওয়া সত্ত্বেও এখানকার জমি এতটাই সরস যে গিরিগাত্রে কৃষক ভাইরা এখনও হাল চালায়। ক্ষুধার্ত শিকড়গুলো সেই পাথর থেকে রসদ সংগ্রহ করে দিনের পর দিন বেঁচে থাকার অদম্য তাড়নায়… বলতে বলতে মাঝপথে থেমে গিয়ে অতনু হঠাৎ একসময় প্রশ্ন করে জানতে চায়, আমার কথায় তুই বিরক্ত হচ্ছিস না তো? শিবনাথ উত্তরে জানায়— না, একেবারেই নয়। তুই বল, আমার ভালো লাগছে শুনতে কথাগুলো।

অতনু বলতে শুরু করে আবার— সেইজন্যেই আমার লেখা দিনলিপির এক জায়গায় আমি লিখে রেখেছি, মৃত্যুর পরে আমার পার্থিব শরীর যেন এই সুবর্ণরেখার তীরেই সৎকার করা হয়।

অতনু বোধহয় আরও কিছু বলতে চাইছিল। এবার বাধা পেল শিবনাথের কথায়। শিবনাথ নিজের মন্তব্য প্রকাশ করল— – রাঁচি সম্বন্ধে তোর যে এত জ্ঞান তা আগে জানা ছিল না আমার। সত্যি প্রশংসনীয়।

অতনু বলে চলে— চৈত্রের সরহুল পরবে তেঁতুলগাছের তলায় মশাল জ্বালিয়ে কালো পাথরে তৈরি জীবন্ত মানুষগুলো যখন আকণ্ঠ হাঁড়িয়া পান করে মাদল আর ঢাক বাজিয়ে মেয়ে-পুরুষে হাত ধরাধরি করে নৃত্যের তালে গান গায় তখন পৃথিবীতে এত যে দুঃখ-কষ্ট আছে তা বিশ্বাস হয় না। এই ছোটোনাগপুর অঞ্চল আর এর সহজ সরল আদিবাসীদের দেখে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে মায় রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত নীরব থাকতে পারেননি। এই অঞ্চলের এতটাই মোহিনী রূপ।

শিবনাথ বিস্ময় প্রকাশ করে বলে— তুই তো দেখছি রীতিমতো গবেষণা পত্র লিখে ফেলার জোগাড় করেছিস। এত খবর সংগ্রহ করিস কী করে?

চটজলদি জবাব অতনুর— মাতালদের যেমন শুঁড়িবাড়ির খোঁজ রাখতে হয়, ঠিক তেমনি যারা গল্প-উপন্যাস লেখেন তাদের বেলাতেও সেই একই যুক্তি। বাড়ি থেকে ডাকবাক্সটা কত পা দূরত্বে সেই খবরটাও রাখতে হয়। রাখাটাই তাদের জীবনের একমাত্র ব্রত, তাদের একমাত্র বৈশিষ্ট্য, পরম অনুসন্ধিৎসার পরিচয়। সত্যি কথা বলতে কি, যা কিছুই করি না কেন সমস্ত অন্তরটা সঁপে দিতে না পারলে জীবনের কোনও কাজেই উৎকর্ষতা লাভ করা যায় না। সেই কাজের সার্থকতাও থাকে না।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...