শিবনাথ প্রতিবাদ করে না। চুপ করে বসে অতনুর কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে থাকে৷ সেই অবসরে অতনুর দৃষ্টি চলে যায় সুদূরের একটি পাহাড়ের চূড়ায়। একভাবে সেইদিকে তাকিয়ে বলতে থাকে— ওদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ওরা বড়োই নিরীহ আর কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। ওদের দেখলে আমার শুধু পিঁপড়েদের কথা মনে পড়ে যায়। পিঁপড়েদের মতো দু'দণ্ডের তবে এরাও কখনও স্থির থাকতে পারে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস এরা মাঠে ফসল ফলায়। ঘরের আশেপাশে বাহারি ফুলের গাছ লাগায়। ওদের ফুল খুব প্রিয়। ফুল পাতা দিয়ে মেয়েরা গয়না তৈরি করে। পাল পার্বণে ওরা ফুলের গয়না পরে নৃত্যগীতে মাতোয়ারা হয়। ভাবাই যায় না স্বাধীনতার প্রাক্কালে ওরা এক সময় অস্ত্র ধারণ করেছিল শয়তান ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ওদের উপর কত অত্যাচার হয়েছিল! আমাদের বিদ্যাসাগর মহাশয় ওদের বড্ড ভালোবাসতেন। ওদের কাছ থেকে বেশি দামে ভুট্টা কিনে ওদেরই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের বিলিয়ে দিতেন।
অনেকক্ষণ পরে শিবনাথ মুখ খোলে— এতেই বোঝা যায় মানুষে মানুষে কত তফাৎ। রাঁচির সাথে আমাদের দু'জনরেই সমান আত্মীয়তা অথচ তুই যেভাবে রাঁচিকে পর্যবেক্ষণ করিস আমি সেইদিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। আমি শুধু দেখি বন, জঙ্গল, পাহাড় আর নদী। এর বাইরে আমার দৃষ্টিতে আর অন্য কিছু ধরা পড়ে না। আমার অভিজ্ঞতায় রাঁচি শহরটিকে একেবারে আর দশটা শহরের মতোই মনে হতো এতদিন। তোর কথায় আমার ভুল ভাঙল। আসলে আমি জগতের বিষয়বস্তুগুলি বিচার করি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা। কিন্তু তুই বিচার করিস হৃদয় দিয়ে।
উত্তরে অতনু জানায়— শুধু বাইরের রূপ দেখেই ভুলে যাস না যেন। আগের তুলনায় রাঁচি এখন অনেকটাই পালটে গিয়েছে। খুবই নোংরা হয়ে গিয়েছে এর চরিত্র। এত নোংরা শহর পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা বলা কঠিন। কথায় কথায় দিনে দুপুরে খুন, রাহাজানি আর বোম ছোড়াছুড়ি। এই শহর একেবারেই অশান্ত। রাঁচির গুন্ডাশাহি যে এখন কোন নিরঙ্কুশস্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তা কল্পনাতীত। এই তো সেদিনের ঘটনা— দুটো গরু বাজারের মধ্যে ঢুকে শিং দিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করছিল। অতি সামান্য একটি তুচ্ছ ঘটনা। অথচ শহরব্যাপী রটে গিয়েছিল। হিন্দু-মুসলমানের রায়ট শুরু হয়ে গিয়েছে। এখনও সুবর্ণরেখার সোনালি জলে মরা মানুষের কঙ্কাল ভেসে যেতে দেখা যায়। সত্যি রাঁচি এক বিচিত্র শহর! মানুষে মানুষে এত হানাহানি আর সহ্য হয় না।