হাওড়া স্টেশন থেকে রামপুরহাট স্পেশাল ধরে সন্ধ্যা ৬.৩৫ মিনিট নাগাদ বর্ধমান পৌঁছোলাম। প্লাটফর্ম থেকে বাইরে এসে গাড়িতে চড়ে আমরা গেলাম কানাইনাটশাল-এ অবস্থিত সেচ ও জলপথ বিভাগের পরিদর্শন ভবন।
পরের দিন সকালে আমরা গাড়িতে চেপে সাতকাহনিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বড়ো রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে ডান দিকে বাঁক নিলাম। এবার ইডেন ক্যানাল ব্রিজ পার হয়ে ধীরে ধীরে দামোদর নদের কাছে চলে এলাম। আমরা একে একে নেমে এলাম দামোদরের তীরে। মেয়েরা পায়ের পাতা ভিজিয়ে নিল নদের জলে।
এনএইচ-২ হাইওয়ে ধরে গলসি পৌঁছোলাম সকাল সাড়ে ৯টায়। আরও কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি পানাগড়ের দিকে বাঁক নিল। দীর্ঘ বনাঞ্চল পার হয়ে গাড়ি বনকাটি পেরিয়ে ১১ মাইলের মোড়ে এসে পৌঁছোল। এখান থেকে গাড়ি বাঁ দিকে ঘুরে গেল। ৩ কিমি দূরে বাংলো। সরু, অসমান রাস্তা। পথের দু’পাশে গ্রাম বাংলার ছবি। আমাদের গাড়ি সাতকাহনিয়া বাংলোর ছায়ামাখা চত্বরে এসে দাঁড়াল।
প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেল বড়ো বড়ো গাছপালায় ঘেরা বাংলোর চৌহদ্দিটাকে। টিনের ছাদ, আটচালা প্যাটার্নে সবুজ রং। সামনের দেয়ালে দুটি রং— – নীচের দিকটা ঘন খয়েরি যেখানে মাটি থেকে উঠে আসা শ্বেত মার্বেলের সিঁড়ি শেষ হয়েছে, তার ওপরের অংশে হাল্কা ক্রিম রং। প্রশস্থ ডাইনিং রুম যার বাম ও ডান পাশে দুটি বড়ো সুসজ্জিত বেডরুম। ডাইনিং রুম-এর পিছন দিকেও একইরকম বারান্দা।
একতলা বিরাট বাংলোটির নাম কেন ‘সাতকাহনিয়া’ তা জানতে পারলাম ম্যানেজারের কাছ থেকে। তিনি জানালেন, ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই বাংলো কম করেও দু’শো বছরের পুরোনো। বাংলোর খড়ের আটচালা ছাদ তৈরি করতে ‘সাত কাহন’ (৭ কাহন মানে ৭ × ৮০ আঁটি = ৫৬০ আঁটি) খড় লেগেছিল। সেই কারণে বাংলোর নাম হয়েছিল ‘সাতকাহনিয়া’। খুব সম্ভবত সেই সময়ে গ্রামের একমাত্র উল্লেখযোগ্য বসতবাড়ি ছিল এই বাংলো, তাই সেই বাংলোর নাম থেকেই গ্রামের নাম হয় সাতকাহনিয়া।
গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অজয় নদ। কাঁচা মাটির রাস্তায় মিনিট ৬-৭ হেঁটে আমরা শীর্ণ নদের দেখা পেলাম। পথের পাশে তাল ও বাঁশ গাছের আধিক্য। চোখে পড়ে তেঁতুল, কলা ও নারকেল গাছ। ফসল কেটে নেওয়া জমিতে রুক্ষতার প্রকাশ। মাটির তৈরি বাড়িগুলোয় খড় অথবা টিনের চাল।
অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পাঠকদের জানিয়ে দিই আমরা ঠিক কোথায় বেড়াতে এসেছি। সাতকাহনিয়া গ্রামের অবস্থান বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কাঁকসা সাব-ডিভিশনে। প্রকৃতপক্ষে গ্রামটি উপজেলা সদর কাঁকসা থেকে প্রায় ১৬ কিমি দূরে অবস্থিত। গ্রামের ভৌগোলিক আয়তন ২০৮.০১ হেক্টর। অজয় নদ বয়ে গিয়েছে গ্রামের পাশ দিয়ে। গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম বনকাটি। গ্রামের নিকটতম শহর দুর্গাপুর, যা ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত।
বাংলোর বাগান থেকে সকালের ঠান্ডা হাওয়া আসছে। দূরে কোথাও পাখি ডাকছে। বাগানে মরশুমি ফুলের শোভা। ভারি ভালো থাকে মন এই সময়। কিছুক্ষণ পরেই মন্দির-জঙ্গল ভ্রমণে বেরোলাম। প্রথম গন্তব্য ১২ কিমি দূরে শ্যামারূপা মন্দির।
গাড়ি গ্রাম পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে চলে এল অযোধ্যা হাটতলায়। ছোটো জায়গা কিন্তু বেশ জমজমাট বাজার- দোকান নিয়ে। দু’পাশে ধানের সবুজ খেত। পর পর ইউক্যালিপটাস আর আম গাছ। বনকাটি পেরিয়ে গেলাম। এবার দু’পাশে শালের জঙ্গল। কয়েক মিনিট পরেই গাড়ি এসে থামল ইছাই ঘোষ নির্মিত এক সুউচ্চ দেউলের সামনে। জায়গাটির নাম গৌরাঙ্গপুর।
দেউলের ঠিক উলটো দিকে রাস্তার অন্য পাড়ে একটি ছোটো কালী মন্দির। দেউলের সংরক্ষিত জায়গায় ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ-এর একটি বিজ্ঞপ্তিতে ওই স্মারকস্তম্ভ (দেউল)-টিকে প্রাচীন স্মারক ও পুরাতাত্ত্বিক স্থল এবং অবশেষ আইন, ১৯৫৮ তথা সংশোধিত ও অনুমোদিত আইন, ২০১০ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় মহত্ত্বপূর্ণ স্মারক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
লেখা আছে, কেউ যদি এই স্মারকের কোনও রকম ধ্বংসসাধন, অপসারণ, ক্ষতি, পরিবর্তন, বিকৃতি বা বিপন্ন সাধন করে— তবে উপরোক্ত আইন অনুসারে তার ২ বছর কারাবাস বা এক লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা একই সঙ্গে সে উভয়দন্ডে দণ্ডিত হতে পারে। এখান থেকে গাড়ি একটু এগিয়ে ডানদিকে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করল।
(ক্রমশ…)