জঙ্গলের মাঝে উঁচু-নীচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগোতে লাগল। কয়েক মিনিট পরেই গড় জঙ্গলের এলাকা শুরু হল। ডান দিকে পথ এগিয়েছে গড়চণ্ডীধামের দিকে, আমরা সোজা পথে এগোলাম। আরও প্রায় ২ কিমি এগোনোর পর জঙ্গল হালকা হয়ে গেল। পৌঁছোলাম শ্যামারূপা কালীমন্দিরের কাছে। পুরোহিত মশাই জানালেন, প্রাচীন এই কালীমন্দিরের এক চমকপ্রদ ইতিহাস আছে। সেই কাহিনি শুনে আমরা অনেক কিছু জানলাম।
তিনি জানালেন, এই মন্দির ১২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। বাংলার সেন বংশের রাজা লক্ষ্মণ সেন (১১৭৮- ১২০৬) দিল্লির সুলতান বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে পরাজিত হয়ে জঙ্গলাকীর্ণ এক আশ্রমের কাছে এসে আত্মগোপন করেন। সেই আশ্রমে তখন এক কাপালিক বাস করতেন যিনি নরবলি দিতে অভ্যস্ত ছিলেন। রাজ্যহারা রাজা লক্ষ্মণ সেন ওই কাপালিককে অনুরোধ করেন নরবলি না দিতে। কিন্তু কাপালিক লক্ষ্মণ সেনের কথা শুনতে রাজি না হয়ে বরং তাঁকে বললেন, রাজা যদি ওই স্থানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নরবলি দেন তবে তিনি হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। ঘটনাক্রমে মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনে সেখানে এসে হাজির হন লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি, গীতগোবিন্দের রচয়িতা জয়দেব। তিনিও ওই কাপালিককে অনুরোধ করেন নরবলি না দিতে। কিন্তু তাতেও কাপালিক রাজি হলেন না। তখন কবি জয়দেবের কাতর প্রার্থনায় মা কালী শ্যামারূপে আবির্ভূতা হন স্বল্প সময়ের জন্য। মা কালীর ওই শ্যামারূপ দেখে কাপালিক নরবলি দেওয়া থেকে বিরত হন। সেই থেকে ওই কালীমন্দির ‘শ্যামারূপা মন্দির’ নামে পরিচিত হয়।
এরপর এগিয়ে গেলাম অনতিদূরে অবস্থিত এক ওয়াচ টাওয়ার-এর কাছে। নজর মিনারের উপর থেকে বিশাল গড় জঙ্গলের বিস্তৃতি দেখে মন ভরে গেল। তারপর গাড়িতে চড়ে এগোলাম কাছেই ‘মেধসাশ্রম’-এর উদ্দেশে। একই পথে কিছু দূর পিছিয়ে এসে বাঁ দিকে নির্দেশিত পথে পড়ে গড়চণ্ডীধাম। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ‘মেধসাশ্রমে’।
জঙ্গলের মাঝে অনেকটা জায়গা জুড়ে আশ্রম। চারিদিক নিস্তব্ধ। দুর্গামণ্ডপে দেখলাম মৃণ্ময়ী মূর্তি অধিষ্ঠিত। কথিত আছে, মধ্যযুগে রাজা সুরথ বঙ্গদেশের এই স্থানেই বসন্তকালে সর্বপ্রথম দুর্গা আরাধনার প্রচলন করেন যা কালক্রমে সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী নবরাত্র দুর্গোৎসবে রূপান্তরিত হয়।
পরবর্তী কালে রাজা সুরথ নিজের সাধনভূমি অজয় নদ (কৃষ্ণা নদী)-র তীরে গহন শালবৃক্ষের অরণ্যে মেধামুনির আশ্রমে মহাকালী মহালক্ষ্মী-মহাসরস্বতী ত্রিমাতার মন্দির নির্মাণ করে সুরক্ষার জন্য উঁচু প্রাচীর বা বেষ্টনদূর্গ তথা গড় নির্মাণ করেন। বর্তমানে এটি সুরথ রাজার মহামায়া ধাম নামে পরিচিত। সুরথ রাজার এই গড়বেষ্টিত ধাম, কালের কবলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে জঙ্গলে পরিণত হলে বর্তমান কাঁকসর বিশাল বনময় অঞ্চল গড়জঙ্গল নামে পরিচিতি লাভ করে।
অবশেষে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মানন্দ গিরি বর্তমান গড়জঙ্গলে জঙ্গলাকীর্ণ সেই পৌরাণিক মেধসাশ্রম তথা গড় চণ্ডীধাম পুনরুদ্ধার করেন এবং প্রাচীন মন্দির সংস্কার করেন।
গড় চণ্ডীধাম দর্শন শেষে গাড়ি আবার গড়জঙ্গলে প্রবেশ করল। কিছুদূর এগিয়ে পৌঁছোলাম তদানীন্তন বাংলার শাষক লক্ষ্মণ সেনের সামন্ত রাজা ইছাই (ঈশ্বরী) ঘোষ নির্মিত গড় (দুর্গ)-র ধ্বংসাবশেষের কাছে। অনেকে মনে করেন ওই গড়ের জন্যই এই জঙ্গল পরিচিত হয় ‘গড়জঙ্গল’ নামে।
শাল, শিমূল, পলাশ ও কুসুমে সমৃদ্ধ এই জঙ্গল। উঁচু-নীচু, সরু লালমাটির পথ। দু’পাশেই ঘন জঙ্গল। পথের পাশে পড়ে রয়েছে সাদা সাদা ফুল। বিশাল গড় জঙ্গলকে আড়াআড়ি ভাবে অতিক্রম করছি। প্রায় আধ ঘণ্টা গাড়ি চলার পরে আমরা জঙ্গল ছেড়ে রাস্তায় এসে পৌঁছোলাম। এরপর বনকাটি পেরিয়ে সাতকাহনিয়া গ্রামের ‘তেপান্তর’ নাট্যশালার প্রবেশদ্বার দিয়ে পৌঁছোলাম নাট্যশালার বিশাল চত্বরে।
গাড়ি থেকে নেমে আমরা একে একে প্রবেশ করলাম নাট্যশালার বিশাল চত্বরে। প্রথমেই এক বিরাট কক্ষে নাট্যমঞ্চ, তার দু’ধারে বিভিন্ন সারিতে দর্শকদের বসার জায়গা। এবার চলে এলাম রুচিপূর্ণ ভাবে সাজানো এক মাঠে। সেখানে একদিকে একটি ডর্মেটরি যেখানে থাকবার জন্য ৩-৪টি ঘর। মাঠের অন্যান্য স্থানে অথিতিদের থাকার জন্য ৮টি দ্বিশয্যা বিশিষ্ট গেস্ট হাউস রয়েছে। তেপান্তর নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চে অন্যান্য নাট্যগোষ্ঠীরাও নিয়মিত ওয়ার্কশপ করে। তাছাড়া ভারত সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকেও মেলে কিছু অনুদান।
তেপান্তর নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা কল্লোল ভট্টাচার্য গুণী মানুষ। পাশাপাশি গ্রামের যুবক-যুবতীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য নাট্টগোষ্ঠী যা আজ স্বনির্ভর। গ্রামীন জীবনভিত্তিক তাঁদের নাটক। জানলাম, তাঁদের নিজস্ব গোশালা ও পোলট্রি রয়েছে, ন্যায্য মূল্যে রয়েছে পরিচ্ছন্ন থাকার জায়গা। তেপান্তর নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চে এসে অন্যান্য নাট্যগোষ্ঠীরা নিয়মিত ওয়ার্কশপ করে। নাট্যগোষ্ঠীর ম্যানেজার-এর কাছ থেকেই জানলাম সেইসব কথা। নাট্যশালার ক্যান্টিনে সকলে মিলে গল্প করতে করতে চা পান করলাম।
একরাশ ভাললাগা নিয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে। কয়েক মিনিট পরেই পৌঁছে গেলাম আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা সাতকাহনিয়ার বাংলোয়। একে একে স্নান সেরে নিলাম আমরা। দুপুর ২টো, খিদে পেয়েছিল সবার। তাই খাবার টেবিলে ভগীরথদার ডাক পড়তেই আমরা গিয়ে বসে পড়লাম। মেগা-ভোজ এবারেও– সুক্তো, মুগের ডাল, আলু-পটলের তরকারি, বেগুনি, খাসির মাংস/ মাছ/ ছানার ডানলা (যে যেটা খাবে), চাটনি, দই এবং রসগোল্লা। রান্নার গুণে এবারেও সকলের পেট ভরাট, অথচ ঘণ্টা দুই পরেই আমাদের ফিরতে হবে গাড়িতে। এখান থেকে বর্ধমান স্টেশনে এসে বাড়ি ফেরার লোকাল ট্রেন ধরলাম।
বিকেল গাড়িতে উঠে বসলাম। বিদায়বেলায় মন খারাপ সকলেরই। সাতকাহনিয়া গ্রামকেও মনে মনে বিদায় জানালাম। চেনা রাস্তায় গাড়ি ফিরে চলল বর্ধমানের পথে। বিকেলবেলা পৌঁছে গেলাম কানাইনাটশালের পরিদর্শন ভবনে। এখানে ১৫-২০ মিনিটের বিরতি। হাত-মুখ ধুয়ে কনফারেন্স রুমে এসে বসলাম। বর্ধমানের স্পেশাল সীতাভোগ কিনে স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। হাওড়াগামী লোকাল ট্রেনে উঠে বসলাম আমরা।